একটা বাবু ঘুমিয়ে আছে। দেখে কেমন যেন মায়া জেগে ওঠে। নিজের অজান্তেই কিছু আদরসূচক শব্দ করে ফেলি। বাবুটা ঘুমিয়ে আছে, শুনতে পাচ্ছে না কিন্তু তারপরও আদর জেগে ওঠে। এখন তো সে ঘুমিয়েই আছে, আদর দিয়ে তো তার দরকার নেই, তবু আদর করতে ইচ্ছে করে।
আচ্ছা এই যে অনুভূতিটা, বাচ্চাদের প্রতি যে প্রত্যেকটা মানুষের একটা কেয়ারিং এর ফিলিংস, একটা মায়া, আদর-ভালোবাসা - আসলে এগুলো তো আল্লাহ প্রদত্ত। একটা বাচ্চা ঘুমিয়ে থাকলেও, তার বাহ্যিক প্রয়োজন না থাকলেও এই যে আদরের ইচ্ছেটা - এগুলো তো আল্লাহ দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কেন দিলেন?
কারণ চটজলদিই মাথায় চলে আসে - কারণ একটা ছোট বাচ্চার এগুলোর খুব প্রয়োজন। একটা বাচ্চার আসলে শুধু মা না, তার আশেপাশের সবার থেকে এটেনশন দরকার, কেয়ারিং দরকার - তাই আল্লাহ এগুলো তার আশেপাশের সবার অন্তরে দিয়ে দেন। যেমন পৃথিবীতে আসার সাথে সাথে তার প্রয়োজনীয় খাবার দিয়ে দেন; বেশি গরম, বেশি ঠান্ডা না, একদম প্রয়োজনীয় তাপমাত্রার খাবার দেন, কারণ ওটাই তার দরকার। তেমনি, সব বাচ্চার প্রতি সব মানুষের ভালোবাসার অনুভূতিগুলো দিয়ে দেন, কারণ তাদের জীবনের এই অংশটাতে এগুলোর খুব দরকার তার।
একটা নতুন জীবন শুরু করার জন্য এই স্নেহ-মায়ার বন্ধনগুলো, এই আদরের হাতগুলোর কত প্রয়োজন! একটা বাচ্চা তাহলে আদরের সাথে জীবনের এই পার্টটা ধীরে ধীরে পার করে, স্নেহের হাত ধরে হাঁটতে শিখে, চারপাশে হাসি মুখ দেখে বড় হয়, স্বাভাবিকভাবে তার নিশ্চয়ই বোধ হয় পৃথিবীটা অনেক আনন্দের একটা জায়গা (যদিও পৃথিবীটা চিনে না তখনও)। সে জীবনটাকে নিশ্চয়ই ভালোবাসতে শিখে।
সে জানে যে আমি পড়ে যেতে নিলেও কেউ ধরে ফেলবে, পড়তে দেবে না। ব্যথা পেলেও সে বুঝে যায় যে, আমার ব্যথা দূর করার মত অনেকেই আছে। কান্না করে ঘুম থেকে উঠলেও সে কাউকে দেখতে পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। সে ভয় পেলেও কোন না কোন হাত এসে স্বান্তনা দেয়। সে মানুষকে দেখে খুশি হয়, হাসে। সে নিশ্চয়ই অনেক আত্মবিশ্বাসী হয়।
অস্বাভাবিক কত কিছুই তো হয়। কিন্তু ছোট বাচ্চারা, যারা তখনো ভাষা বুঝেনি,ওদের জন্য এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? সে এই মায়াগুলো এই কেয়ারিংগুলো ডিজার্ভ করে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় পায়ও।
আল্লাহ তো প্রত্যেক জিনিসের ভিতর একটা নমুনা রেখেছেন। বাচ্চাদের জীবনের এই পার্টটা দেখে কি আমরা বুঝতে পারি যে, প্রতিটা নতুন জীবনের জন্য স্নেহের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, কেয়ারিং করা, পাশে থাকাটা কতটা জরুরী?
আমরা জীবনের এক একটা অংশে এসে অনেকেই ভাবি, আমাকে কেউ বুঝতে চায় না, আমার পাশে কেউ থাকে না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু উলটো করে কি ভাবি? অর্থাৎ যারা জীবনের নতুন পার্টগুলো শুরু করছে, তাদের প্রতি কি আমাদের এই চিন্তাটা আসে যে, তার প্রতি হেল্পফুল থাকা, তার এই জীবনের ছোট ছোট সমস্যাগুলোর কেয়ার করা কতটা জরুরী?
একটা বাচ্চা ছোট একটা আঘাত পায়, কাঁদে, আমরা সাথে সাথে আদর করে কোলে তুলে নিই, ব্যথার জায়গাতে তাড়াতাড়ি আদর করে ব্যথা কমাবার চেষ্টা করি। কিন্তু কেন? এমন তো না যে, তাকে আদর না করলে ব্যথা কমতো না। ব্যথা কমে যেত, কিন্তু বাচ্চারা জন্য এটা বোঝা খুব জরুরী যে, তাকে কেউ এতটা অবহেলা করছে না।
জীবনের এক একটা অংশকে আমরা এক একটা নতুন জীবন বলে প্রায়ই বর্ণনা করি। যেমন, কৈশোর জীবন, স্কুলজীবন, কলেজজীবন, বিবাহিত-জীবন, চাকরি-জীবন ইত্যাদি। আসলে জীবনের প্রতিটা অংশই তো 'নতুন করে' কিছু একটা শুরু করা, তাই না? আর এই প্রত্যেকটা জীবনেই কিন্তু এই কেয়ারিংটা প্রয়োজন।
আমরা হয়তো মনে করি, সে ম্যাচিউরড, তার এটা বুঝে নেওয়া উচিত ইত্যাদি। কিন্তু এখানে ঔচিত্যের প্রশ্ন না, সে 'নতুন' - এভাবে কি চিন্তা করা কঠিন? তার এই নতুন জীবনে ঠিক ঐভাবেই কিছু স্নেহের হাত, কিছু সাহচর্য, কিছু হাসিমুখ দরকার আত্মবিশ্বাসের জন্য; যেভাবে তার ছোটবেলায় তার দরকার ছিল। তারপর সে যখন একটু পথ এগিয়ে যাবে, দাঁড়াতে শিখবে, হাঁটতে শিখবে, ব্যালেন্স করা শিখবে; আস্তে আস্তে তার হাত ছেড়ে দেওয়া যায়, বাকি পথটুকু যেন নিজে এগিয়ে যেতে পারে।
হ্যাঁ, কেউ ঠেকে শিখে। অনাদরে, অবহেলায় কি বাচ্চারা বড় হয় না? তাদের অনেকেই তো এই অবহেলা থেকে আস্তে আস্তে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যেতে শিখে। এসটাবলিশড হয়। কিন্তু এটা কি কাম্য?আমরা কেন আল্লাহর নিজের দেওয়া নমুনা ছেড়ে, এই ঠেকে শেখার ফর্মুলা প্রয়োগ করবো? পৃথিবীটা কি আরেকটু সুন্দর হতে পারে না? আরেকটু স্নেহশীল, আরেকটু কেয়ারিং হতে পারে না?