Monday, November 05, 2018

টুকরো ভাবনা

একটা মেয়ে সংসার জীবনে প্রচুর কষ্ট করতে পারে, শ্বশুর-শাশুড়ি স্বামী ননদ-দেবরের নির্যাতন কথাবার্তা সইতে পারে,  শেষে দুই তিন সন্তানের হাত ধরে চলে আসতে পারে;  বাপ-মায়ের উপর বোঝা  (সেটাই তো ভাবে) হয়ে তাদের কথাও সহ্য করতে পারে ; কানতে পারে আর এই কথাও বলতে পারে আল্লাহ কেন তাকে এত দুঃখ-কষ্ট দিচ্ছেন সে জানে না;
কিন্তু বিয়ের আগে কষ্ট করে এই কথাটা কেন বলে না যে আমি শ্বশুর-শাশুড়ি থেকে আলাদা বাসায় থাকবো? মনোমালিন্যের মধ্যে যাব না? 

Friday, September 28, 2018

জাহিলিয়াতের জ্ঞান



অনেকদিন ধরেই কত কিছুই না লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু লিখার উপকরণ কতই না দূরে দূরে থাকে। কতদিন পর আল্লাহ তৌফিক দিচ্ছেন কিছু একটা লিখার, তাও মনে কত কৃত্রিমতা।

সিরিয়া নাশীদ শুনে কয়টা দিন ধরে মনটা একটু একটু না ভালো লেগে থাকে। প্রাচীর বইটা পড়ছি। বইটার ইন্ট্রোডাকশন দিতে গিয়ে অনুবাদক বলেছেন, অন্যদের লিখা যদি কানে বাজে তবে কারাগারের মুসলিম ভাইদের কথা হৃদয়ে গিয়ে বাজে। কে জানে, হয়তো আসলেই তাই। তারিক মেহান্নার কথা পড়ছি। ভাবতে অবাক লাগে, কত গভীর গভীর চিন্তা এই কারাগারে বসে তাঁরা করতে পারেন। এক একটা আয়াত যা সবসময়ই সাধারণভাবে পড়ছি বা শুনছি, তার কত তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ, চিন্তার কত খোরাক তারা বের করে লিখছেন। বাস্তবিকই, ক্বুরআন কত বড় মোজেযা, কত গভীর চিন্তাভাবনার উৎস। এসব কথা তো কবে থেকেই জানি। তবে বাস্তবে তার সামান্য একটু ছোঁয়া মনে হয় এই লেখাগুলো থেকে পেলাম। খুব সম্ভব, এটা আমাদের সেই আত্মত্যাগী ভাইদের আত্মত্যাগের পুরস্কার। তারা কারাগারে থেকেও যে মুক্ত, আর আমরা মুক্ত থেকেও যে কারাগারে - এই লিখাগুলোই তার যথেষ্ট প্রমাণ। এখন এই কথাও আরেকটু পরিষ্কার করে বুঝে আসে যে, দুনিয়া কত বড় কারাগার।

যাই হোক, ক্বুরআন এবং আপনি পর্ব ০৯ তে তারিক মেহান্না অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় উল্লেখ করেছেন। ইসলাম পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার জন্য একজন মানুষের 'জাহিলিয়াতের জ্ঞান' থাকা অনেক জরুরী। বিষয়টা অত্যন্ত চমকপ্রদ। ঠিক এই বিষয়টা নিয়ে আমি মাঝে মাঝেই চিন্তা করি। আমার অভিজ্ঞতা হল, কারো যখন পাপকাজের সাথে সখ্যতা থাকে তারপর সে যখন ইসলামকে বুঝে শুনে পাপকাজ থেকে আন্তরিকভাবে তাওবা করে তার পরবর্তী জীবন হয় আন্তরিক একটা ইসলাম আদর্শ সমৃদ্ধ জীবন । এই নমুনা যেমন আছে একজন কাফেরের ইসলাম গ্রহণ পরবর্তী জীবনে, একইভাবে ইসলাম সম্বন্ধে অজ্ঞ মুসলিমের ইসলামের দিকে ফিরে আসার পরের জীবনে। অন্যদিকে, এই অভিজ্ঞতাও আমার আছে, কোন কোন পরিবারের ক্ষেত্রে লক্ষ করেছি, যে কোন একটা পরিবার যদি শুরু থেকে ইসলামের উপর পরিচালিত হয়, তার সদস্যদের মধ্যে ইসলামের বুঝ মনে হয় যেন (একান্ত আমারই মনে হয়, আল্লাহ মাফ করুন) একটু অসম্পূর্ণ থাকতে পারে । যেমন তাদের মধ্যে হয়ত জাহিলিয়াতের বিষয়াবলির দিকে আগ্রহ দেখা যায়। হয়ত মাদ্রাসায় পড়েছে, বা পরিবারে ইসলামের বিষয়াবলির যথেষ্ট আলোচনা হয় তারপরও সাধারণ শিক্ষা, সেই সার্টিফিকেট, ফেসবুক বা ইন্টারনেটের মত বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহ আছে, সেসবকে কিছুটা হলেও উঁচু চোখে দেখে। অন্যদিকে যারা সাধারণ শিক্ষায় পড়েছে, ইন্টারনেট ব্যবহার করে অভ্যস্ত হয়েছে- তাদের অনেককেই হয়ত দেখা যাবে নিজের সন্তানদের মাদ্রাসায় দিবার ফিকির করছে, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে দিয়েছে, ইন্টারনেটের সাথে সম্পর্ক কমিয়ে বা বন্ধ করে দিয়েছে।

এখন গতি কি সেদিকেই নিয়ে যাবে, এই মাদ্রাসা পড়ুয়া সন্তান বড় হয়ে নিজের মূল্য অনুধাবন করতে পারবে? জাহিলিয়াতের বিষয়ের প্রতি তার ঘৃণা সৃষ্টি হবে কি?

আলহামদুলিল্লাহ, প্রাপ্ত সম্পদের মূল্য বুঝে এমন অনেক সূর্যসন্তানের কথা ইতিহাসেও পাওয়া যায়, এখনও। কিন্তু বিপরীত নমুনাও চোখের সামনে দেখতে পাই, সংখ্যাটা খুব কম নয় ।

কিন্তু কোন জিনিস এই মাদ্রাসা পড়ুয়া সন্তানকে বা দ্বীনি পরিবেশে বড় হওয়া এই সন্তানকে এই দ্বীনি পরিবেশের, তার অর্জিত ইলমের , তার বুকে রক্ষিত ক্বুরআনের মর্যাদা বুঝাতে পারবে? যেমনভাবে একজন জাহিল আগ্রহ করে ক্বুরআন শিখে তার মূল্য দেয়, অন্তত তেমনভাবে দেবে? মনে হয়, এর উত্তর এখানেই। যখন কেউ জাহিলিয়াতের আনাচে কানাচে সম্পর্কে জেনে ফেলবে, সেগুলো তার মনে আর কোন আগ্রহই জন্ম দেবে না। তখন সে নিজের মর্যাদা, নিজের প্রাপ্ত সম্পদের মর্যাদা ইনশা আল্লাহ বুঝতে পারবে। বাকি হিদায়াত তো আসলে আল্লহর পক্ষ থেকে।

যেমন সাহাবীরা ছিলেন। তারা জাহিলিয়াতের মাঝে ডুবে ছিলেন। তার ভিতর থেকে ভিতর পর্যন্ত তারা চিনে ফেলেছিলেন। তারপর যখন ইসলাম তাঁদের জীবনে এলো, তারা তা বুঝে নিলেন এবং নিঃসংকোচে জাহিলিয়াতের আবর্জনা থেকে নিজেকে তুলে এনে ইসলামের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে গেলেন। সম্ভবত এভাবেই বর্তমান হিন্দু-খ্রিস্টান থেকে কনভার্ট হওয়া মুসলমানরা এত মজবুত হয়। এভাবে জাহিলিয়াতের জীবন যাপন করা মুসলমান যখন ফিরে আসে, তাঁদের আমলী জীবন বানাবার আগ্রহও ঈর্ষা করার মতন হয়।

এ কারণে হয়তো উচিত, সন্তানদেরকে শুধু দ্বীনি শিক্ষা, দ্বীনের ফজীলত শিক্ষা দেওয়া নয়; পাশাপাশি আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নোংরা আবর্জনা দূর্গন্ধময় অনৈসলামিক বিষয়গুলোর স্বরূপ_ইসলামের চোখে হোক বা একান্ত দুনিয়াবীভাবেই_চিনিয়ে দেওয়া, যাতে এসব সম্পর্কে ঘৃণা সৃষ্টি হয়। নিজে থেকে সরে থাকার উদ্যম থাকে।

অন্ধকার চিনি বলেই তো আলোর এত মূল্য। দুনিয়াকে যত চিনব, বুঝব; দ্বীনের মূল্য আমার কাছে ততই বাড়বে। মূর্খতাকে যত চিনছি, বুঝছি; জ্ঞান ততই প্রিয় হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ জাহিলিয়াত কে চিনে নেব তার ভিতর পর্যন্ত; আর যাতে কোন আগ্রহই বাকি না থাকে, যাতে দ্বীন আমার কাছে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়তে থাকে, যাতে প্রিয় থেকে প্রিয় হয়। ওয়ামা তাওফীক্বী ইল্লা বিল্লাহ।

Saturday, September 15, 2018

নিরাপদ সড়ক চাই

(নিরাপদ সড়ক চাই  আন্দোলনের সময় লিখেছিলাম।)

ঢাকার সড়কগুলোর আশেপাশে দাঁড়ি-টুপিওয়ালাদের বেশি করে কেন দেখা যাচ্ছে না? এটা কি চোখের ভুল না ক্যামেরার ফোকাসের ভুল?
হে দ্বীনের বুঝওয়ালা, হে প্রাক্টিসিং মুসলিম,  হে দায়িত্ববোধসম্পন্ন দাঈ, হে কাশ্মীর-ফিলিস্তিন-আফগানিস্তানের যুদ্ধে নেমে পড়তে প্রাণ আনচান করা মুজাহিদ ভাই, আপনি এখন কোথায় হারিয়ে গেলেন? নিরাপদ সড়ক কি কেবল সাধারণ নাগরিক অধিকার? এটা কি মনুষ্যত্বের দাবি না? এটা কি মুসলমানদের প্রাণের দাবি নয়? যারা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন, তারা কি মুসলিম উম্মাহর অংশ না? তাঁদের প্রাণ হারানোয় কি আপনার উম্মাহ-দেহে ব্যথা অনুভব করছেন না? মুসলমানের জান-প্রাণ, সময় বাঁচাতে সাহ্যয্য করা; এটা কি মুসলমান হিসেবে আপনার কর্তব্য না? আপনার সামর্থ্যের কাছে কি এটা সাধারণ জনগণের হক না যে, তারা একটা নিরাপদ সড়ক পাবে?
এটা তো কোন রাজনৈতিক ইস্যু নয়, কোন দলীয় ব্যাপার নয়, এখানে প্রতিপক্ষ নেই। আপনাদের উচিত ছিল , বহু আগেই নেমে পড়া। তাহলে হয়ত সড়ক অনেক আগেই নিরাপদ হত, আপনার উসিলায় আল্লাহ হয়ত অনেক প্রাণ বাঁচিয়ে দিতেন দুর্ঘটনা হতে, আপনার উসিলায়। আপনি দেরি করেছেন, নামেননি। আল্লাহ নামিয়ে দিয়েছেন আরেক দলকে। যেখানে আপনি হতে পারতেন, সেখানে আরেক দল নেমে কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ তাদের পূর্ণ হিদায়াত দিন, তাদের মকবুল করুন। কিন্তু আপনার তো উচিত ছিলো, তাদের এরকম পদক্ষেপের যাতে দরকারই না পড়ে। তারা যাতে নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে বরাবর যাতায়াত করতে পারে। চোখের সামনে কোন মৃত্যু তাদের দেখতে না হয়। হাত কেটে 'We Want Justice' লিখে দেখাতে না হয়।
হ্যাঁ, এখন তারা দেখিয়ে দিয়েছে। এখন আর আপনার সামনে কোন যুক্তি নেই। তারা তাদের ক্ষমতা দেখিয়েছে, এবার আপনার পালা; এবার আপনি আপনার সামর্থ্য দেখাবেন। এবার দেখাবেন, দ্বীন কি প্র্যাক্টিকেল কিছু? দ্বীন কি ব্যাপক শান্তির কিছু? নাকি দ্বীন মানে মাদ্রাসা শিক্ষা , ব্যাক্তিগত আমল, তাবলীগ, দ্বীনি বার্তাবাহী স্ট্যাটাস, শেয়ার , বই লিখা-কিনা আর আক্ষেপ,ট্রল এটুকুই।
একটু দেরি হয়ে গেছে, কিন্তু খুব বেশি নয়। আপনার ছোট ভাইয়েরা করে দেখিয়েছে, এবার আপনি চালিয়ে দেখান। তারা হয়ত খুব বেশি দিন ধরে রাখতে পারবে না, এত সুন্দর স্বস্তিদায়ক জিনিস হুজুগের খাতায় হয়ত চলে যাবে। কিন্তু আপনার দায়িত্ব, আপনার কর্তব্য; আপনি তা হতে দেবেন না। তারা হাল ধরেছে, এবার আপনি পালে হাওয়া লাগিয়ে দিন। সাধারণ ছাত্রদের ক্ষমতা মানুষ দেখেছে , এবার দাঁড়ি-টুপিওয়ালা, দ্বীনি বুঝজ্ঞানসম্পন্ন আপনাকে আল্লাহ যে কিছু যোগ্যতা দিয়েছেন সেটা দেখান।  তরুণ ছাত্রদের কাছে যান, তাদের কাঁধে হাত রাখুন। তাদের বাহ্যিক সাপোর্ট দিন।
আপনার কি মনে হয়? সড়ক নিরাপদ করা দ্বীন প্রচার নয়? এক এক জামাত এক এক দিন ডিউটি দিন। মানুষকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে সুযোগ করে দিন। একবার নয়, বারবার। তাদের অন্তরের দোয়া আপনার দিকে আসতে দিন। দ্বীন কি আর ইসলাম কি, তাদের জানিয়ে দিন বুঝিয়ে দিন। এভাবে দাওয়াত দিন তাদের, এভাবে।
অন্তত আপনার এলাকার সড়কের লিড নিয়ে নিন (তারপর হয়ত সড়কের নেমে পড়া তরুনদের লিডও দিতে হবে, যদি অন্য কেউ এগিয়ে না আসে) । এটুকু আপনাকে করতেই হবে। ছাত্ররা করেছে, আপনাকে করতেই হবে। এলাকার তরুণদের নিয়ে শূরা গঠন করে ফেলুন। মাশোয়ারা করুন। তারপর কাজে নেমে পড়ুন। আপনার এলাকার সড়ক যাতে অনিরাপদ না থাকে। যদি থাকে, তবে তা আপনারই অযোগ্যতার প্রমাণ। আল্লাহর জন্য করুন, আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করবেন। মুসলমানদের জন্য করুন, আপনার 'ভাই' এর জন্য করুন, যে ভাই কাশ্মীর ফিলিস্তিন আরাকানে নয়, যে ভাই আপনার পাশে আপনার কাছে; তার জন্য করুন।
 আপনি কি এখনো মুজাহিদ হবার স্বপ্ন দেখেন?

আল্লাহ আমাদের সবাইকে তৌফিক দিন। 

Thursday, April 26, 2018

আমরা উম্মত একটাই

কুফর আর মুসলিম শক্তির মধ্যে চলমান যুদ্ধের কথা ভাবতে গিয়ে প্রায়ই ভাবি, মুসলমানদের এই এই দেশগুলো আক্রান্ত হয়েছে। আর আমাদের এদিকে কিছু দেশ বাকি আছে। মাঝে মাঝে ভাবি, তারপর কোন দেশটি আক্রান্ত হতে পারে? 

কিন্তু হঠাৎ অনুভব হলো, এই ভাবনা কিছুটা জাতীয়তাবাদী হয়ে গেলো কিনা?! আমরা মুসলিম, এটাই আমাদের পরিচয়। আমাদের প্রিয় নবী (স) কি এটাই শিখাননি যে, আমরা সমস্ত মুসলমান এক দেহের মত। সুতরাং , এটা ভাবা হয়তো মোটেই ঠিক নয় যে, আমাদের মধ্যে এই এই দেশ বাকি আছে। বিশুদ্ধ ভাবনা তো এটাই হবে যে, আমরা আক্রান্ত। যেমন আমাদের বাংলাদেশ যখন আক্রান্ত হলো আমাদের সবাই কিন্তু ভেবেছে, আমরা আক্রান্ত হয়ে গেছি পুরো বাংলাদেশই। তখন সবাই এমনকি যাদের নিজস্ব গ্রাম শহর হয়তো তখনো আক্রান্ত হয়নি, তারাও ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশরক্ষায়, নয় কি?

জাতীয়তাবাদী ধারণা ইসলামের কোন অংশ নয়। কুফফার শক্তি নিজের স্বার্থ হাসিলেই মুসলমানদের মধ্যে এই ধারণা প্রচার করেছে, মানচিত্র দিয়ে আলাদা করে দিয়েছে ধীরে ধীরে। আমরা বোকার মত তা কবুল করেছি আর সমস্ত শক্তি, সামর্থ্য এবং যোগ্যতা থাকা সত্বেও নিজেরা পরস্পর অনেক দূরে সরে থেকে নিজেকে দূর্বল থেকে দূর্বল করে রেখেছি। ওদিকে কুফফাররা নিজেদের সুবিধামত পারস্পরিক ঐক্য সুসংহত করছে। অথচ বাহ্যিক স্বার্থেও যদি আমরা একতাবদ্ধ হতাম!

সুতরাং, চলুন এবং চলুন আমরা অবশ্যই সংশোধিত হয়ে যাই যে, আমরা অন্তর দ্বারা বিশ্বাস করি পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম আমরা সবাই এক দেহ , এক প্রাণ , এক জাতি। আমাদের যে অংশই আক্রান্ত হয়ে যাই, আমরা তা এভাবেই ভাবব, এভাবেই ব্যক্ত করব যে, আমাদের ফিলিস্তিনের অংশ আক্রান্ত হয়ে গেছে বা আমাদের সিরিয়ার অংশ বা কাশ্মীরের অংশ আক্রান্ত হয়েছে। সেভাবেই ব্যথিত হবো , সেভাবেই উদ্বেলিত হবো, যেভাবে আমাদের পাশের জেলা আক্রান্ত হলে হতাম। 
আর আমরা আমাদের আক্রান্ত অংশের জন্য কি করবো? সেটা আমাদের আর ভাবতে হবে না। আমাদের প্রিয় হাবীব(স) আমাদের উম্মাহকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, এবং সেটাই একমাত্র সত্য , তা যদি অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারি - তাহলে খুব সম্ভব আমাদের আর আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে ভাবতে হবে না। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর বাংলার মানুষ যতটুকু ভেবেছে, তার থেকে কম ভাবলেও আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে অবগতি এসে যাবে ইনশাআল্লাহ।

চলুন, যেভাবে সম্ভব জাতীয়তাবাদের দূর্গন্ধ গা থেকে, মুখ থেকে এবং অন্তর থেকে ঝেড়ে ফেলি। আমরা তাওহীদের পতাকাতলে জড় হয়ে যাই আর মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে দেখি, আল্লাহ আমাদেরকে বিশ্বের কতটুকু পর্যন্ত বিস্তৃত করে রেখেছেন।

হাসবুনাল্লাহ। ওয়া লা হাওলা ওয়া লা ক্বুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ।।

Monday, April 23, 2018

কারাগারে মুক্তি

নতুন এক টার্মের সাথে পরিচিত হলাম। কারাগারে মুক্তি। জীবনে প্রথমবারের মত বুঝতে পারলাম, কারাগার আসলে কারাগার  নয়, বরং মুক্তিস্থল। যেমন আমরা জানি শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনই সার্থক জীবন, তেমনই শৃঙ্খলবদ্ধ জীবনও ক্ষেত্রবিশেষে স্বাধীন হতে পারে। কিন্তু এটা চট করে বোঝা যায় না।

প্রথমত ধরা যাক, একজন মানুষকে...আসলে আমি এখানে মুসলিম কারাবন্দীদের নিয়েই আলোচনা করব, কারণ মুসলিমদের কাছে যে সম্পদ আছে তা অন্য কারো কাছেই নেই আর একমাত্র এই সম্পদই একজন মুসলিম কারাবন্দীকে স্বাধীন বানিয়েছে; তো একজন মুসলিমকে ১৭ বছরের কারাদন্ড দেয়া  হল। আপাতদৃষ্টিতে আমরা কি মনে করি? মনে করি যে, আফসোস! একজন মানুষের জীবন থেকে ১৭ টি বছর হারিয়ে যাবে! সে কারাগারে ঢুকবে যুবক হয়ে, বেরোবে প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ হয়ে। আফসোস, মাত্র একটিই ক্ষণস্থায়ী জীবন , তা থেকে ১৭টি বছর নিষ্ফল ব্যর্থ হয়ে যাবে!  
আসলেই কি এ সময়টা সম্পূর্ণ বৃথা?
আমরা জানি, আল্লাহ যখন কাউকে এক দিক থেকে পঙ্গু করে পাঠান, অন্যদিকে তাকে প্রখর করে দেন। আমাদের চোখের সামনে এর প্রচুর উদাহরণ আছে। যেমন, একজন হয়তো অন্ধ কিন্তু তার শ্রবণশক্তি খুব তীব্র। আমি একজন অন্ধকে দেখেছিলাম, যে মানুষের হাত ধরে তার পরিচয় বুঝে ফেলত। সুবহানাল্লাহ! একইভাবে কেউ হয়তো কানে কম শুনে, অথচ সে মানুষের ঠোঁট দেখে কথা বুঝতে পারে। আমার পরিচিত এমন একজন কানে-কম-শোনা মানুষ একটু বয়স হয়ে যাওয়া সত্বেও আলহামদুলিল্লাহ তুলনামূলকভাবে দ্রুত ক্বুরআন পড়া শিখে নিয়েছে। এমনিতেও আমরা জানি, আমরা যখন বিভিন্ন বিষয় থেকে মনোযোগ হটিয়ে কেবল একটি দিকে নিবদ্ধ করি সে লাইনে আমরা অনেক দ্রুত এগিয়ে যাই...
আমাদের কারাগারে বন্দি ভাইদের ব্যাপারেও কথা একই। তাদেরকে জোর করে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। এমনকি কাউকে আইসোলেটেড সেলে রেখে  বছরের পর বছর একাকীত্ব দ্বারা নির্যাতন করা হয়। কিন্তু আরেকটু খেয়াল করে দেখি, তাদের মনোযোগ কিন্তু আর অনেকদিকে বিক্ষিপ্ত হতে পারে না। তাদের অনেকেই, যারা বুঝ রাখেন, এই দীর্ঘ ক'টা বছর পান আল্লাহর সাথে একান্তই একান্তে কাটাবার সুযোগ; সুযোগ পান তাদের রবের ইলমের মাঝে ডুবে যাবার। আমরা কি অনুমান করতে পারি, আল্লাহ তাআ'লা একাকীত্বের মাধ্যমে তাদেরকে কতটা নৈকট্য দান করেন! এই ত্যাগের মাধ্যমে কতটা সম্পদ তারা অর্জন করেন, তা অনুধাবন করা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব?
কারাগারবন্দী আমাদের ভাইদের লেখাগুলোর পাতা একটু ওল্টালে ব্যাপারটা একটু ধরা পড়ে। অবশ্য জানিনা, আসলে কতটা বোঝা যায়। এই যে আমি 'প্রাচীর' পড়ছি, ক্বুরআন এর এক একটি আয়াতের আলোকে তাদের লেখাগুলো পড়ে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি। ক্বুরআনের গভীরতার সীমা নেই, এটা জানা কথা; কিন্তু কেবল 'জানা' কথা। ক্বুরআনের কোন একটা আয়াতের, যা হয়তো সবসময়ই পড়ে আসছি, একেবারে অন্যরকম একটা ব্যাখ্যা হতে পারে তা কল্পনাতেও আসত না । এই কারাবন্দী ভাইয়েরা জীবনের বিভিন্ন অংশের এক একটা তাৎপর্যময় দিক কিভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, পড়তে গেলে কেবল আশ্চর্য লাগে! সত্যিই যেন দিলে গিয়ে আঘাত লাগে। আল্লাহ আমাকে অতিরঞ্জন করা থেকে হিফাযত করুন। আসলে আল্লাহ এই কারাবন্দী ভাইদের উপর কেমন নিয়ামত বর্ষণ করছেন, তার একটা নমুনাই হয়ত এই লেখাগুলো। হ্যাঁ, তাফসীর পড়তে গিয়েও আমরা হয়ত একইরকম বা তার থেকেও বেশি অবাক হয়ে যাবো; কৃতজ্ঞতায় আমাদের মাথা আরো নত হয়ে যাবে। কিন্তু ভাববার বিষয়, এ সমস্ত লেখাগুলো কিন্তু কারাগারে তৈরি হচ্ছে। বন্দির জীবনে স্বাধীনতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চিন্তার স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতার নমুনা আমাদের মুক্ত জীবনে পাই কি?

দ্বিতীয়ত, আমরা জানি প্রত্যেক নবী-রাসূলই কাফেরদের হাতে অত্যাচারিত হয়েছেন। সাহাবারাও হয়েছেন। তাবেয়ীরাও। কেন? একমাত্র সত্যকে তুলে ধরার জন্য। সত্যকে সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের যেসব ভাইয়েরা অত্যাচারিত হচ্ছেন, জেলের স্বাদ ভোগ করছেন; তারা কিন্তু এই আদর্শেরই অনুসারী, এই আদর্শের গর্বিত উত্তরসূরী।  আমরা জানি, যার গায়ে একবার জেলের সিল লেগে যায়, তার জীবনে চিরস্থায়ীভাবে যেন কলঙ্কের একটা ছাপ লেগে যায়। অথচ কি আশ্চর্য! এই যে জেলখাটা আমাদের মুসলিম ভাইরা; তারা কিন্তু দিন যায়, মাস যায় , বছর ঘুরে- আমাদের চোখে সম্মানের আসনই দখল করতে থাকেন। সারা দুনিয়ার মুসলিম, অন্তর থেকে তাকে ভালবাসে, নয় কি? বলছি, দেখুন কি অদ্ভূত। যা সাধারণ মানুষের জন্য অপমানের বিষয়; একমাত্র ইসলামের জন্য, আল্লাহর জন্য ত্যাগ স্বীকারের কারণে একজন মুসলিমের জীবনে তা হয়ে যায় গর্বের বিষয়।
এখন আরেকদিকে লক্ষ করে দেখি, আল্লাহ যাকে দিয়ে এই ত্যাগ স্বীকার করিয়েছেন, তাকে দিয়ে কাজ নিয়েছেন। আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দারাই নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন। চিন্তা করে দেখি, আমাদের প্রিয় হাবীব(স) কি জেল খাটেননি? হ্যাঁ, তাঁকে হয়ত কেউ ধরে জেলে ঢুকিয়ে দেয়নি। কিন্তু চলুন , সেই তিনটি বছরের কথা চিন্তা করে দেখি- যখন কাফিররা মুসলিমদেরকে বয়কট করে তাঁদেরকে সব ধরনের সুবিধা, এমনকি মৌলিক চাহিদা থেকেও বঞ্চিত করেছিল। সেটা কি কারাগারের জীবন থেকে কম কিছু ছিল? বাহিরের যে কোন মেলামেশা , লেনদেন থেকে তাঁরা সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিলেন।
তো যা বলছি, আমাদের যেসব ভাই কারাভোগ করছেন- আমরা ধরে নিতে পারি,ইনশাআল্লাহ  আল্লাহ তাঁদের দিয়ে বড় কাজ নিবেন। তাঁদের লেখাতেই তো তার কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

তৃতীয়ত, হুযুর(স) তো বলেই দিয়েছেন- দুনিয়া মুমিনের জন্য কারাগার। হাদীসটাকে মনে রেখে আমরা আমাদের জীবনকে কারাগারের জীবনের সাথে তুলনা করে দেখি। একটু ভিন্নভাবে দেখি। ধরা যাক, একজন মানুষের বিশ বছরের কারাদন্ড হলো। সে যদি একজন সাধারণ বুঝের মানুষ হয়, কারাগারে তার জীবনটা কিভাবে কাটবে? কোনরকমভাবে, কেবল সময় কাটানোর জন্যই সময় কাটানো। উদ্দেশ্যহীন। দরকারমত মৌলিক প্রয়োজন সারে, তার আর তেমন কোন কাজ নেই। হ্যাঁ এভাবেই সে যখন বিশ বছর কাটিয়ে দেয় , তার এই সময়টা ব্যর্থই হয়। আসলেই এই সময়টা অপচয়ের খাতায় চলে যায়।
কিন্তু বিপরীতভাবে , একজন সচেতন মুসলিম যখন হক্বের কথা বলবার জন্য সত্যকে তুলে ধরবার জন্য জেল খাটে, তার জেল খাটা কি একইরকম হয়? সে তার সময়ের মূল্য বোঝে । জেলে থাকা সত্বেও তার সময়টাকে কাজে লাগাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে, বরং মন-দিল লাগিয়ে সময় কাজে লাগাবার একটা ফুরসতই তৈরি হয়। এই ব্যাপারটা কিছুটা আমি উপরে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছি। আর 'প্রাচীর' বইয়ে ভাই তারিক মেহান্না এ ব্যাপারটা দু' তিনবার উল্লেখ করেছেন।
এখন আমাদের সাধারণ জীবনের দিকে লক্ষ করে দেখি। এটা তো কারাগারের জীবনের সময়ের মতই, কেবল ব্যাপ্তি জানা নেই। তো এই সময়কে কেউ নিরর্থক কাটিয়ে দেয়, আপাতপ্রয়োজনীয় কাজগুলো সারতে সারতেই। আর কেউ এর মূল্য বোঝে, একে কাজে লাগাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। আল্লাহ আমাদের শেষোক্তদের দলভুক্ত করুন। আমীন।

কারাগারের সাথে জীবনের তুলনা করলে আরো কিছু কথা বলতে মন চায়। যেমন একজন মুমিন, তার জন্য দুনিয়া কারাগার। একজন সত্যনিষ্ঠ কারাবন্দী যেমন সম্মানের পাত্র, তেমন একজন মুমিন শৃঙ্খলাপূর্ণ, বিধি-বিধানের আলোকে জীবন কাটিয়ে সম্মানের পাত্র হয়। সেই কারাবন্দীর মধ্যে যেমন সুপ্ত সম্ভাবনার ঝিলিক দেখা যেতে থাকে, ঠিক একইভাবে একজন মুমিনের মাঝেও। একজন সচেতন  কারাবন্দী যেমন সময়কে কাজে লাগিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যায়, এমনকি জেলে বসে বসে সে (আপাতদৃষ্টিতে) মুক্ত মানুষের পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতে থাকে; তেমনি একজন মুমিন, যে আল্লাহর বিধানের শৃঙ্খলাবদ্ধ, একইভাবে আল্লাহর বিধানের শৃঙ্খলমুক্ত মানুষের পথপ্রদর্শকের কাজ করতে থাকে।

শেষ কথা, আমাদের কারাবন্দি ভাইদের কিছু কিছু লেখা পড়ে বোধ হয়, তারা চিন্তার ক্ষেত্রে কতটা স্বাধীন। কত সূক্ষ্ম বা ব্যাপ্ত তাঁদের উপলদ্ধি। এই ক্ষেত্রেও আমরা তুলনা দিতে পারি প্রকৃত মুমিনদের। প্রকৃত মুমিনরা কতটা মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারে, কত সূক্ষ্ম হয় তাঁদের উপলদ্ধি। যারা মুমিন নয়, তারা তো এটা কল্পনাই করতে পারবে না। প্রকৃত মুমিনরা বাস্তব জীবনেও কতটা স্বাধীন। এই স্বাধীনতার নমুনা এই যামানায় আমরা কতটুকু দেখতে পাব জানি না, তবে সাহাবাদের যামানার দিকে, তাঁদের জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করে তার কিছু নমুনা পাই। ইনশাআল্লাহ সামনে আবার এই নমুনা আসবে। দুনিয়া নামক কারাগারের প্রকৃত বাসিন্দারা স্বাধীনতার স্বরূপ দেখিয়ে দেবে ইনশাআল্লাহ। ওয়ামা তাওফীক্বী ইল্লা বিল্লাহ। আলাইহি তাওয়াক্কালতু ওয়া লা হাওলা ওয়া লা ক্বুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ।