অনেকদিন ধরেই কত কিছুই না লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু লিখার উপকরণ কতই না দূরে দূরে থাকে। কতদিন পর আল্লাহ তৌফিক দিচ্ছেন কিছু একটা লিখার, তাও মনে কত কৃত্রিমতা।
সিরিয়া নাশীদ শুনে কয়টা দিন ধরে মনটা একটু একটু না ভালো লেগে থাকে। প্রাচীর বইটা পড়ছি। বইটার ইন্ট্রোডাকশন দিতে গিয়ে অনুবাদক বলেছেন, অন্যদের লিখা যদি কানে বাজে তবে কারাগারের মুসলিম ভাইদের কথা হৃদয়ে গিয়ে বাজে। কে জানে, হয়তো আসলেই তাই। তারিক মেহান্নার কথা পড়ছি। ভাবতে অবাক লাগে, কত গভীর গভীর চিন্তা এই কারাগারে বসে তাঁরা করতে পারেন। এক একটা আয়াত যা সবসময়ই সাধারণভাবে পড়ছি বা শুনছি, তার কত তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ, চিন্তার কত খোরাক তারা বের করে লিখছেন। বাস্তবিকই, ক্বুরআন কত বড় মোজেযা, কত গভীর চিন্তাভাবনার উৎস। এসব কথা তো কবে থেকেই জানি। তবে বাস্তবে তার সামান্য একটু ছোঁয়া মনে হয় এই লেখাগুলো থেকে পেলাম। খুব সম্ভব, এটা আমাদের সেই আত্মত্যাগী ভাইদের আত্মত্যাগের পুরস্কার। তারা কারাগারে থেকেও যে মুক্ত, আর আমরা মুক্ত থেকেও যে কারাগারে - এই লিখাগুলোই তার যথেষ্ট প্রমাণ। এখন এই কথাও আরেকটু পরিষ্কার করে বুঝে আসে যে, দুনিয়া কত বড় কারাগার।
যাই হোক, ক্বুরআন এবং আপনি পর্ব ০৯ তে তারিক মেহান্না অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় উল্লেখ করেছেন। ইসলাম পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার জন্য একজন মানুষের 'জাহিলিয়াতের জ্ঞান' থাকা অনেক জরুরী। বিষয়টা অত্যন্ত চমকপ্রদ। ঠিক এই বিষয়টা নিয়ে আমি মাঝে মাঝেই চিন্তা করি। আমার অভিজ্ঞতা হল, কারো যখন পাপকাজের সাথে সখ্যতা থাকে তারপর সে যখন ইসলামকে বুঝে শুনে পাপকাজ থেকে আন্তরিকভাবে তাওবা করে তার পরবর্তী জীবন হয় আন্তরিক একটা ইসলাম আদর্শ সমৃদ্ধ জীবন । এই নমুনা যেমন আছে একজন কাফেরের ইসলাম গ্রহণ পরবর্তী জীবনে, একইভাবে ইসলাম সম্বন্ধে অজ্ঞ মুসলিমের ইসলামের দিকে ফিরে আসার পরের জীবনে। অন্যদিকে, এই অভিজ্ঞতাও আমার আছে, কোন কোন পরিবারের ক্ষেত্রে লক্ষ করেছি, যে কোন একটা পরিবার যদি শুরু থেকে ইসলামের উপর পরিচালিত হয়, তার সদস্যদের মধ্যে ইসলামের বুঝ মনে হয় যেন (একান্ত আমারই মনে হয়, আল্লাহ মাফ করুন) একটু অসম্পূর্ণ থাকতে পারে । যেমন তাদের মধ্যে হয়ত জাহিলিয়াতের বিষয়াবলির দিকে আগ্রহ দেখা যায়। হয়ত মাদ্রাসায় পড়েছে, বা পরিবারে ইসলামের বিষয়াবলির যথেষ্ট আলোচনা হয় তারপরও সাধারণ শিক্ষা, সেই সার্টিফিকেট, ফেসবুক বা ইন্টারনেটের মত বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহ আছে, সেসবকে কিছুটা হলেও উঁচু চোখে দেখে। অন্যদিকে যারা সাধারণ শিক্ষায় পড়েছে, ইন্টারনেট ব্যবহার করে অভ্যস্ত হয়েছে- তাদের অনেককেই হয়ত দেখা যাবে নিজের সন্তানদের মাদ্রাসায় দিবার ফিকির করছে, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে দিয়েছে, ইন্টারনেটের সাথে সম্পর্ক কমিয়ে বা বন্ধ করে দিয়েছে।
এখন গতি কি সেদিকেই নিয়ে যাবে, এই মাদ্রাসা পড়ুয়া সন্তান বড় হয়ে নিজের মূল্য অনুধাবন করতে পারবে? জাহিলিয়াতের বিষয়ের প্রতি তার ঘৃণা সৃষ্টি হবে কি?
আলহামদুলিল্লাহ, প্রাপ্ত সম্পদের মূল্য বুঝে এমন অনেক সূর্যসন্তানের কথা ইতিহাসেও পাওয়া যায়, এখনও। কিন্তু বিপরীত নমুনাও চোখের সামনে দেখতে পাই, সংখ্যাটা খুব কম নয় ।
কিন্তু কোন জিনিস এই মাদ্রাসা পড়ুয়া সন্তানকে বা দ্বীনি পরিবেশে বড় হওয়া এই সন্তানকে এই দ্বীনি পরিবেশের, তার অর্জিত ইলমের , তার বুকে রক্ষিত ক্বুরআনের মর্যাদা বুঝাতে পারবে? যেমনভাবে একজন জাহিল আগ্রহ করে ক্বুরআন শিখে তার মূল্য দেয়, অন্তত তেমনভাবে দেবে? মনে হয়, এর উত্তর এখানেই। যখন কেউ জাহিলিয়াতের আনাচে কানাচে সম্পর্কে জেনে ফেলবে, সেগুলো তার মনে আর কোন আগ্রহই জন্ম দেবে না। তখন সে নিজের মর্যাদা, নিজের প্রাপ্ত সম্পদের মর্যাদা ইনশা আল্লাহ বুঝতে পারবে। বাকি হিদায়াত তো আসলে আল্লহর পক্ষ থেকে।
যেমন সাহাবীরা ছিলেন। তারা জাহিলিয়াতের মাঝে ডুবে ছিলেন। তার ভিতর থেকে ভিতর পর্যন্ত তারা চিনে ফেলেছিলেন। তারপর যখন ইসলাম তাঁদের জীবনে এলো, তারা তা বুঝে নিলেন এবং নিঃসংকোচে জাহিলিয়াতের আবর্জনা থেকে নিজেকে তুলে এনে ইসলামের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে গেলেন। সম্ভবত এভাবেই বর্তমান হিন্দু-খ্রিস্টান থেকে কনভার্ট হওয়া মুসলমানরা এত মজবুত হয়। এভাবে জাহিলিয়াতের জীবন যাপন করা মুসলমান যখন ফিরে আসে, তাঁদের আমলী জীবন বানাবার আগ্রহও ঈর্ষা করার মতন হয়।
এ কারণে হয়তো উচিত, সন্তানদেরকে শুধু দ্বীনি শিক্ষা, দ্বীনের ফজীলত শিক্ষা দেওয়া নয়; পাশাপাশি আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নোংরা আবর্জনা দূর্গন্ধময় অনৈসলামিক বিষয়গুলোর স্বরূপ_ইসলামের চোখে হোক বা একান্ত দুনিয়াবীভাবেই_চিনিয়ে দেওয়া, যাতে এসব সম্পর্কে ঘৃণা সৃষ্টি হয়। নিজে থেকে সরে থাকার উদ্যম থাকে।
অন্ধকার চিনি বলেই তো আলোর এত মূল্য। দুনিয়াকে যত চিনব, বুঝব; দ্বীনের মূল্য আমার কাছে ততই বাড়বে। মূর্খতাকে যত চিনছি, বুঝছি; জ্ঞান ততই প্রিয় হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ জাহিলিয়াত কে চিনে নেব তার ভিতর পর্যন্ত; আর যাতে কোন আগ্রহই বাকি না থাকে, যাতে দ্বীন আমার কাছে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়তে থাকে, যাতে প্রিয় থেকে প্রিয় হয়। ওয়ামা তাওফীক্বী ইল্লা বিল্লাহ।
No comments:
Post a Comment