Friday, June 24, 2022

মাগরিবের সালাত শেষে ফেরার পথে ব্রীজটার উপর একটু থমকে দাঁড়িয়ে ছিল দীপ। সূর্য ডুবে গেছে বেশ আগেই, কিন্তু আকাশের বুকে স্মৃতি হিসেবে রেখে গেছে লালিমা। দিগন্তে পানির বুকে সে লালিমা অদ্ভূত এক অজানা অনুভূতির সৃষ্টি করে। যেন অপার কোন রহস্য লুকিয়ে আছে দিগন্তে।

সূর্যাস্তের সময় সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে অসীমে একাকার হতে চাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি দীপের কখনো। কিন্তু মনে হচ্ছে, সমুদ্র-সাক্ষাৎ না হবার যে আফসোস এতোদিন মনে পুষে এসেছে, তা আর আপাতত অনুভব না করলেও চলবে। দিগন্ত বিস্তৃত এই পানির নিচে আসলে ঢাকা পড়ে আছে দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত। কয়েকদিন আগেও ভাবুক দীপ এসে যখন এই ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে ঠিক এভাবে দিগন্তের দিকে তাকাত, সবুজ শ্যামলিমার সৌন্দর্যে সবকিছু ভুলে যেতে চাইতো। মাঝে মাঝেই রাত্রি নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করত সে, বহুদূর থেকে বয়ে আসা বাতাসে স্মৃতিকাতর হতে চাইতো, আর একটা আরেকটার গায়ে ঢলে পড়া চারাগুলো দেখে বিমোহিত হয়ে মনে মনে বলে উঠতো - আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবার। 

কে জানত, কয়েকদিন পরই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর মত করে এক সমুদ্র-সাক্ষাৎ হয়ে যাবে তার, আর আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ফেনা দেখে অবাক হয়ে সে বলে উঠবে - আল্লাহু আকবার। সত্যিই, কার ক্ষমতা আছে এত দ্রুত পটভূমি পালটে ফেলার? তবু মানুষ কার কাছে নত হয়?

সামান্য শোরগোল কানে আসতে পিছন ফিরল দীপ। কিছু দূরে তিনটা লোডেড ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। এগুলো আপাতত ওদেরই - আল-মুসাআদা ফাউন্ডেশন এর। তার সামনেই কয়েকজন দাঁড়িয়ে কী যেন বলাবলি করছে অস্থির হয়ে। ওদের কে চেনে দীপ - সবাই ই তাদের আল-মুসাআদা ফাউন্ডেশন এর। এর মধ্যে তিনজন হচ্ছে তাদের মুকাদ্দিমা টিমের। দ্বিতীয়বারের মত বন্যা এসে সব ভাসিয়ে নেবার পরপরই খুব দ্রুত তৈরি করা হয়েছিল এই মুকাদ্দিমা টিম। তাদেরকে তৈরি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে। উদ্দেশ্য - ফান্ড তুলে ত্রাণ তৈরি করতে করতে যেন টার্গেট লোকেশন সম্পর্কে ভালো একটা ধারণা হয়ে যায়, এতে দ্রুত ফলদায়কভাবে সাহায্য পৌঁছানো সম্ভব হবে।

দীপকে দেখে এগিয়ে আসলো মুকাদ্দিমা টিমের সাদাত। সাদাতের টিম গিয়েছিল উত্তর-পশ্চিমে, বোয়ালিয়া গ্রামের দিকে। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞাসা করল দীপ - কী খবর সাদাত? 

- অবস্থা ভয়ানক ভাইজান...

হড়বড় করে যা বলল সাদাত, তার সারাংশ হচ্ছে - বোয়ালিয়া গ্রাম শুধু ডুবেনি খুব ভালোভাবেই ডুবে গেছে, রাস্তার পানি পৌঁছে গেছে বুক পর্যন্ত। কিছু কিছু বাড়িঘর সামান্য উঁচুতে তৈরি হওয়াতে, সেগুলোতে পানি যদিও কিছুটা কম ঢুকেছে, কিন্তু বেশির ভাগ বাড়ির সবকিছু ডুবে গেছে। গ্রামে ছোটখাটো দুই-তিনটা টিলা থাকাতে কিছু কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে, তারপরও বেশ কিছু পরিবারের এক-দুজন করে সদস্য হারাতে হয়েছে। কারো পক্ষে তাও সম্ভব হয়নি, তারা চালার উপর উঠে আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু যে কোন মুহুর্তে ডুবে যাবার আশংকা। একে তো স্রোতের তীব্রতা, তার ওপর সাঁতার জানে এমন মানুষের সংখ্যাও বেশ কম। খুব দ্রুত এদেরকে উদ্ধার করা সম্ভব না হলে, অনেক প্রাণ একসাথে হারিয়ে যাবে।

একটু থেমে আরো দুয়েকটা সংবাদ দিলো সাদাত। টিলায় আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলোতে জরিপ করতে গিয়েছিল তারা। এক হিসেবে ভালো আছে তারা - অন্তত প্রাণ হারানোর ভয় নেই। কিন্তু তিনজন প্রেগন্যান্ট মহিলা আছেন, যাদের সময় প্রায় শেষের দিকে। এর মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর, এক-দুইদিনের ভিতর ব্যবস্থা না নিলে যে কোন মুহুর্তে মা-সন্তান দুজনকেই হারাতে হতে পারে। চালার উপর আশ্রিতদের মধ্যেও আছেন এমন একজন - আল্লাহর ইচ্ছেয় তার সময় যদিও ঘনিয়ে আসেনি; কিন্তু নিরাপত্তার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা করা দরকার।

সব শুনে দুই-এক সেকেন্ড চিন্তা করল দীপ। টুকটাক দুই-তিনটা প্রশ্ন করল। ফাউন্ডেশনের সহকারী জামিল ভাই দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশেই। তাকে বলল - ভাই আপনি কিছু ফার্স্ট এইড নিয়ে ট্রলারে এখুনি রওয়ানা দিয়ে দিন। আমি ত্রাণ নিয়ে একটু পরেই ইনশাআল্লাহ ফলো করছি।

জামিল ভাই মাথা নেড়ে জিজ্ঞাসা করলেন - আপনি কী করবেন ভাই? 

- আপনি যান ভাই। আমি আসছি একটু পরই।

বলতে বলতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো দীপ। 

মাগরিবের সালাত আদায় করে কিছু কাপড় গুছাতে গুছাতে অযীফা আদায় করে নিচ্ছিল শ্রেয়া। দরজার টোকার শব্দে একটু অবাক হলো। দীপের তো এখন আসার কথা নয়!

দরজা খুলে বিস্মিত স্মরে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করল - কী ব্যাপার! তুমি না বলেছিলে সালাত শেষে ত্রাণ নিয়ে দ্রুত চলে যাবে!

একটু হাসল দীপ - আরে ঢুকতে তো দিবে!

দরজা লাগিয়ে দ্রুত রান্নাঘরে চলে এল শ্রেয়া। দীপ এসেছে এবং তার চেহারায় তাড়াহুড়া নেই। তার মানে না হলেও অন্তত ১০-১৫ মিনিট বাসায় থাকবে, এর মধ্যে যদি ছোট করে কিছু হাজির করা যায়...

কড়াই বসিয়ে ফ্রিজ থেকে ফ্রোজেন সিঙ্গাড়া বের করে নিল শ্রেয়া। ভাগ্যিস, চায়ের লিকার করাই ছিল! চায়ের পাত্রটাও বসাতে বসাতে আড়চোখে দেখলো দীপ হাজির। 

 - হ্যাঁ এখন বলেন শুনি, কী করতে এসেছেন। এখানেই বা কী করছেন?

মুচকি হাসল দীপ। শেলফ থেকে দুটো কাপ নামিয়ে নিল - হেল্প নিতে এসেছি। 

কিছু বুঝলো না শ্রেয়া। এ কেমন আজগুবি কথা হলো! হেল্প করছে, আর বলছে হেল্প নিতে এসেছে...

দ্রুত হাতে দুজনে নাস্তা রেডি করে বসলো। দীপের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে শ্রেয়া চায়ে চুমুক দিলো। দীপ একটা সিঙাড়া হাতে নিয়ে বললো - 

- শুনো, একসময়ে একজন মানুষ ছিলেন। পৃথিবীর অর্ধেকটার উপর ছড়ি ঘুরাতেন। চলো আজকে তার সম্পর্কে একটু মুযাকারা করি। 

শুনে একটু হাসি পেল শ্রেয়ার। এ কথার মানে হচ্ছে শ্রেয়াকে এখন বসে বসে কোন জানা গল্প শুনতে হবে। গল্প শেষে দীপ তার কোন একটা সিদ্ধান্তের কথা তাকে জানাবে, তারপর কনক্লুডিং লাইন হিসেবে বলবে - 'এতটুকু কি আমরা করতে পারি না?' তার কনক্লুডিং লাইন শুনে শ্রেয়া বাধ্য মেয়ের মতো তার সিদ্ধান্তে সায় জানাবে। 

কিন্তু এই তাড়াহুড়ার সময়ে দীপের এই কাহিনী করার মানে কী, বুঝতে পারছে না শ্রেয়া। তাহলে কি দীপ ত্রাণ নিয়ে যাবে না? একটু মনখারাপ হলো শ্রেয়ার। অনেক আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে এলাকার মেয়েদের সাথে সেও ত্রাণের প্যাকেটগুলো গুছিয়ে দিয়েছিল। এ কথা ভেবে খুশি ছিল যে, কিছু তো করতে পারছে আর নিজে যেতে না পারলেও দীপ যাবে ভেবে মনটা ভালো হয়ে যাচ্ছিল তার। এখন কি তাহলে...

তার চিন্তার স্রোত টের পেল দীপ। হেসে বলল - শুনো আমরা যদি একটু মুযাকারা করি, আমাদের কাজে ইখলাস তৈরি হবে, উদ্দীপনা বাড়বে। তাছাড়া এতো কষ্ট করে চা টা বানিয়ে আনলাম, শেষ করতে একটু সময় লাগবে তো! 

সায় না দিয়ে পারল না শ্রেয়া - হ্যাঁ বলো।

- তো অর্ধরাজ্যের রাজা একদিন ঘুরছেন। ঘুরছেন মরুভূমিতে। ঘুরে ঘুরে দেখছেন, এমন কেউ আছে কিনা যে তৃষ্ণার্ত, বা ক্ষুধার্ত অথবা অন্য কোন ভীষণ বিপদে। অথবা, অল্প বিপদেও কেউ আছে কী না। কারণ তিনি রাজা হলেও তো তার মনে ভয়। তিনি তো জানেন যে, তাঁর দিকে কেউ কড়া নজর রাখছে। তিনি তাঁর দায়িত্ব সামান্য শিথিলতা দেখালেও ধরা পড়বার ভয়! তো তিনি চারদিক ঘুরে ফিরে দেখছেন।
তিনি যে রাজা, আমীরুল মুমিনীন, কেউ তো জানে না। সাধারণ বেদুইনের বেশে হাঁটছেন। হঠাৎ শুনতে পেলেন চিৎকারের আওয়াজ। আর্তনাদ ভেসে আসছে এক তাঁবু থেকে।

জানা গল্প হলেও আগ্রহ নিয়ে শুনছে শ্রেয়া। বলার ভঙ্গিতে জানা গল্পও এক এক সময়ে অসাধারণ লাগে।

সিঙ্গাড়ায় ছোট কামড় দিয়ে বলে গেল দীপ - তো অর্ধরাজ্যের রাজা তাড়াতাড়ি তাঁবুটার দিকে এগিয়ে গেলেন। বাইরে বসে থাকা বেদুইন লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ কী হয়েছে ভাই? কে এতো কষ্টের আওয়াজ করছে? 
লোকটা বিরক্ত হলো - নিজের কাছে যাও তো ভাই, আমাকে বিরক্ত করো না। এমনিতেই বহুত ঝামেলার মাঝে আছি।
কিন্তু অর্ধরাজ্যের রাজা তাকে ছাড়বেনই বা কেন! ধরে বসলেন - বলো না ভাই! হয়তো কোন সাহায্য করতে পারবো! 
অনেক গাঁইগুঁই করে তারপর বললো লোকটা, তিনি বাবা হতে যাচ্ছেন কিছু পরেই। ইমার্জেন্সি সাপোর্ট দরকার। কিন্তু এই রাতের বেলা এই মরুভূমিতে কোথায়ই বা পাবেন ইমার্জেন্সি হেল্প! স্ত্রীকে নিয়ে শহরে যাবার মতো অবস্থাও নেই, রেখে যাবার অবস্থাও নেই। কী করবেন ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না। 
শুনে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন অর্ধরাজ্যের রাজা। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন।  বাড়িতে গিয়ে স্ত্রীকে বললেন - বড় একটা ব্যবসায়ের সময় হয়েছে!  সাওয়াব অর্জনের সময় এসেছে...

আর লম্বা করতে দিলো না শ্রেয়া। হাসিমুখে বলে উঠল - তাই তুমিও তোমার স্ত্রীকে বলতে এসেছো যে সাওয়াব অর্জনের সময় হয়েছে! এতটুকু না করলে তা তো তোমার জন্য সত্যিই শোভা পেত না! 

চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলো দীপ। শ্রেয়া উঠে পড়ল। বিস্তারিত পরেও শোনা যাবে। এখন দ্রুত কিছু গুছিয়ে নিতে হবে। 

বিয়ের খুব বেশিদিন হয়নি তখন। তিন কি চার মাস। ভর দুপুরে ঘরে বসে খুব মন দিয়ে একটা বই পড়ছিল শ্রেয়া। হঠাৎ দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ। পাশের বাসার চাচীমার আওয়াজ শুনে দ্রুত খুলে দিল দরজা। প্রচন্ড গরমে ঘেমে নেয়ে আছেন চাচীমা। চোখে-মুখে পেরেশানির ছাপ স্পষ্ট। ঢুকেই বললেন - মা! নীনার পানি ভেঙে গেছে। তোমার কথা বলছে খুব! একটু আসবে? 

এ অবস্থায় না যাওয়ার কোন মানে হয় না। নীনা শ্রেয়ারই সমবয়সী। কিন্তু এর মধ্যে বিয়েতো হয়েছেই,  অলরেডি বাচ্চা ডেলিভারির টাইমও চলে আসছিল। এ জন্যেই মায়ের বাড়িতে আসা, আর প্রতিবেশী ভাবি হিসেবে শ্রেয়ার সাথে বন্ধুত্ব। দ্বীনের বুঝে একটু পার্থক্য থাকলেও তাদের বন্ধুত্বে সেটা বাধা হয়নি। তাই এই কঠিন সময়ে তাকেই তলব! এখন তো অবশ্যই যেতে হবে!

গিয়েছিল শ্রেয়া! বাচ্চাটা বের হওয়া পর্যন্ত পাশে ছিল। কিন্তু নিষ্পাপ দেহটা রুহ নিয়ে বেরোতে পারেনি। কীভাবে কী হয়েছিল বুঝতে পারেনি শ্রেয়া। শুধু বুঝেছে - দ্বীনদারিতার অভাবে একদিকে কী ভীষণ নির্লজ্জতা, আরেকদিকে অনভিজ্ঞ আয়ার হাতে নীনার কলিজার মৃত্যু। 
বাচ্চাটা যখন বের হতে শুরু করেছিল, রুহটা ছিল তখনো। কিন্তু দেহটা বের হতে হতে কীভাবে যেন প্রাণটাও চলে গিয়েছিল, এতটুকুই বুঝেছিল শ্রেয়া। 

তারপর ফুটফুটে মুখটা দেখেছিল সে, আর দেখেছিল মায়ের আর্তনাদ। সেদিন শ্রেয়া নিজেও কান্না আটকাতে পারেনি। এমনকি তার স্বাভাবিক হতেও দু-এক সপ্তাহ লেগে গিয়েছিল। তার বিষণ্ণতা দীপকেও স্পর্শ করত, কিন্তু তার কী-ই বা করার আছে। এমনি স্বান্তনা দিতো। 
তারপর একদিন দীপ ই তাকে প্রস্তাব দিলো - যদি চাও তো তোমাকে ব্যবস্থা করে দিই। একটা নার্সিং ট্রেনিং করে রাখো। হঠাৎ কাজে লেগে যাবে। 

প্রস্তাবটা শ্রেয়ার মনে ধরায় প্রেগনেন্সি রিলেটেড একটা ওয়ার্কশপে ওকে ভর্তি করিয়ে দেয় দীপ। কয়েকমাসে খুব আগ্রহ নিয়েই এটা শিখেছিল শ্রেয়া। ইকরামুল মুসলিমিনের নতুন সুযোগ তৈরি হবে ভেবে খুব ভালো লাগতো তার। তাছাড়া তার খুব মনে হত, দ্বীনের সাথে সম্পর্ক রাখে এরকম সব মেয়েরই এ ব্যাপারে প্রাথমিক ট্রেনিং নিয়ে রাখা উচিত। এ ব্যাপারে অনেককেই সে এখন উৎসাহিত করে। 

তারপর কয়েক জায়গায় গিয়েছিল শ্রেয়া ডেলিভারির সময়ে, কিন্তু বলা যায় অভিজ্ঞতা নিতে গিয়েছিল; শেখা কাজে লাগানোর সুযোগ আসেনি তেমন একটা...

---
অল্প কয়েকটা বাসন পড়ে ছিল সিংকে। শ্রেয়া রেডি হতে হতে সেগুলো ধুয়ে রেখে এসে দাঁড়াল দীপ। শ্রেয়াকে রেডি হতে দেখছে। জিজ্ঞাসা করল - কোথায় যেতে হবে জিজ্ঞাসা করলে না? 

দীপকে উসখুস করতে দেখে মজা পাচ্ছে শ্রেয়া - কেন, তুমি যেখানে খুশি নিয়ে যাবে, যাবো! এ ব্যাপারে সন্দেহ হচ্ছে নাকি? শুনি কোথায় নিয়ে যাবে, মঙ্গলগ্রহ? 

- না, অনেক দূরে যাবো। ট্রলারে করে যাবো। অনেক দূরে একটা দ্বীপে যাবো। 

- কী! 
অবাক হবে, খুশি হবে, না কী করবে ভেবে ভ্যাবাচেকা খেল শ্রেয়া।

হতভম্ব করে দিতে পারে এখন দীপের মজা লাগছে। কথা না বাড়িয়ে ছোট করে ডিটেইলস জানালো শ্রেয়াকে। আল্লাহকে পরম শুকরিয়া জানালো মনে মনে শ্রেয়া। এমন একটা সুযোগ পেয়ে, সর্বোপরি এমন ইকরামের জন্য প্রস্তুত জীবনসঙ্গীকে পেয়েছে বলে। 

ভীষণ লজ্জা লাগছে শ্রেয়ার। ভাগ্যিস অন্ধকার! না হলে মনে মনে 'ধরণী দ্বি-ধা হ' জপত। কিম্ভূতাকার লাগছে নিশ্চয়ই তাকে। কিন্তু কিছু করার ছিল না। এ সময়ে নিজেকে যত ইন্ডিপেন্ডেন্ট রাখা যায় ততই ভালো। টিপ টিপ বৃষ্টি তো হচ্ছেই। তাই বোরকার উপর একটা রেইন জ্যাকেট চাপিয়েছে। বড় হিজাবটা আজকে আর পরেনি, নড়াচড়ার সুবিধা হবে ভেবে ছোট হিজাবটাই চড়িয়ে এসেছে। বন্যার পানিতে পা ডুবাতে হবে নিশ্চয়ই যে কোন সময়ে, অথচ উপযুক্ত কিছুই ছিল না ঘরে। খালি পায়েও আসা যাবে না, আবার সাধারণ মোজা পরে আসলেও ভিজে কেলেঙ্কারি হবে! শেষমেষ একটা চামড়ার মোজা পেয়ে সেটাই পরে এসেছে, আবার বন্যার পানির কথা ভেবে হাঁটু পর্যন্ত পলিথিনও বেঁধে নিতে হয়েছে।
মনে মনে দীপকে বকছে শ্রেয়া। যদিও দীপেরও কিছু করার ছিল না, বাড়তি জিনিস জোগাড় করার সময় এমনিতেও নেই। তবু মনে মনে উধোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে যদি একটু শান্তি পাওয়া যায়! জোরে জোরে বললে তো নিশ্চয়ই বেজার হয়ে তাকে আর আনতোই না। যাব্বাবা, যা পেয়েছে তাই স্বান্তনা! 

চারপাশটা একটু দেখে নিলো শ্রেয়া। একটু দূরে লোডেড ট্রাকগুলো দাঁড়িয়ে আছে। এর পর থেকে আর ট্রাক যাওয়ার উপায় নেই। বাকি পথটা নৌকা বা ট্রলারে করেই টেনে নিতে হবে, কিছু করার নেই। এজন্য গাড়ি থেকে নেমে সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু একা লাগছে তার। দীপকে বলেও ছিল, একটু দেখবে নাকি তার সাথে আসার মত কাউকে পাওয়া যায় কিনা। দীপ মানা করল, তাছাড়া তাতে অনেক বেশি দেরি হয়ে যেত। তার পক্ষপাতি ছিল না দীপ। 
যাক, দীপকে না বলে লুকিয়ে ছোট একটা ছুরি নিয়ে নিয়েছে শ্রেয়া। একটু নিজেকে ভরসা দেওয়া আরকি! তেমন রিস্কের হলে তো দীপ নিজেই চিন্তা করতো না।  

বন্যার পানির গর্জনে অবাক লাগছে শ্রেয়ার। পানির স্রোত দেখে মনটা নরম হয়ে আসে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ! কত দ্রুত আল্লাহর শাস্তি এসে গ্রেপ্তার করে নিতে পারে! তবু একটু যদি বোধোদয় হত মানুষের! নিজে নিজে একটু তিলাওয়াত করতে ইচ্ছে করছে শ্রেয়ার... 

দীপ একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। শ্রেয়াকে দেখে দু'একজন একটু আপত্তি জানিয়েছিল। 'ভাই প্রাণ বড় না মান বড়?' এই কথা বলে তাদেরকে থামিয়ে দিয়েছে দীপ। এখন কথা হচ্ছে লোডিং নিয়ে। ফাউন্ডেশনের একটা ট্রলার আগে থেকেই ছিল, তারপর আর দু'টা ট্রলার ভাড়া করা হয়েছে। কয়েকটা নৌকাও নেয়া হয়েছে। কিন্তু এতদূর পর্যন্ত নৌকাগুলো কীভাবে নিবে তাই নিয়ে ভাবছে সবাই। 

অবশেষে ঠিক হলো, একটা ট্রলারে দীপ শ্রেয়াকে নিয়ে উঠে যাবে। সাথে ত্রাণ নিবে যতটা সম্ভব। আর দুটো ট্রলারের একটা তো জামিল ভাই আগেই নিয়ে গেছেন, অন্য ট্রলারে ফাউন্ডেশনের অন্যরা উঠে যাবে। দুটো ট্রলারের সাথেই দু/একটা করে নৌকা বেঁধে নেওয়া হবে, নৌকায় ত্রাণ থাকবে, মাঝিও থাকবে। ট্রলারের স্পিড খুব না উঠলেও মোটামুটি মধ্যম গতিতে পৌঁছে যাওয়া যাবে। আর বাকি নৌকাগুলো ধীরে ধীরে আসতে থাকুক। 

ততক্ষণে ইশার সময় হয়ে এসেছে। মোটামুটি একটা শুকনো জায়গা দেখে জামাত করে নামাজ পড়ে নিলো ওরা। তারপর লোডিং শেষ করে উঠে বসল সবাই। 

টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে এখনো। শ্রেয়ার অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, অনেক পথ পাড়ি দিয়ে খুব অজানা কোথাও যাচ্ছে। অন্তর সুকূনে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। একবার আকাশের দিকে তাকালো শ্রেয়া। পাশে বসা দীপকে একটু স্পর্শ করলো। এমন ভরসা থাকলে পৃথিবীর কোন জায়গাতে যেতেই শ্রেয়ার কোন দ্বিধা নেই! 

No comments:

Post a Comment