Monday, October 17, 2022

বিবাহবিভীষিকা ও আমরা

 'বিয়ে কঠিন' - প্রসঙ্গে যে আলোচনাগুলো উঠে আসে তার প্রায় সবটা জুড়ে থাকে বিভিন্ন ধরনের বিদআত, কনেপক্ষের বড় অংকের মোহরের দাবি, বরপক্ষের যৌতুক অথবা কন্যার রূপের দাবি, বাবা-মা এর বিভিন্ন কারণে অমত ইত্যাদি। স্বয়ং বিবাহকেই কীভাবে কঠিন হিসেবে অবিবাহিতা মেয়ের কাছে প্রতীয়মান থাকে সেটা সযত্নে বা অযত্নে অবহেলায় আলোচনা থেকে একরকম উহ্যই রাখা হয়। 
এ কাঠিন্যের ফল হচ্ছে অভিভাবক ও কন্যা দুপক্ষেরই উত্তম সময়ে বিবাহ থেকে নিবৃত্ত রাখা ও থাকা, তারপর সামগ্রিকভাবে কন্যার বিবাহ-পূর্ব বা পরবর্তী জীবনে এমন সমস্যায় পড়া যা কন্যার কোনভাবেই প্রাপ্য ছিল না। অথচ সঠিক সময়ে না সে বুঝতে পারে, না বুঝতে পারে তার অভিভাবক। অবশেষে যখন অনেক কিছু বোঝার সময় হয়ে যায়, তখন আর পিছিয়ে এসে পুনরাবৃত্তির সুযোগ থাকে না; শুধু আফসোস করাটুকু বাকি থাকে। 

- পড়াশোনা করে না তো, বিয়ের পর জামাইয়ের বাড়ি হাঁড়ি ঠেলবে গিয়ে। (বিয়ে করলে জামাইয়ের বাড়ি হাঁড়ি ঠেলাই হচ্ছে কাজ)
- রান্না শিখো না যে! শ্বশুরবাড়ী গিয়ে রান্না করে খাওয়াতে হবে না? (শ্বশুরবাড়ী গেলে রান্না করে খাওয়ানোটা অন্যতম কাজ, এজন্য বিয়ের আগেই রান্না শেখা দরকার)
- জামাই কি বসায় বসায় খাওয়াবে? (জামাইরা বসিয়ে খাওয়ায় না, কাজের বিনিময়ে খাওয়ায়)

আমরা (এ ধরনের কন্যারা) বড় হই বিয়ে সম্পর্কে এ ধরনের বিভিন্ন বিরূপ মন্তব্য শুনে শুনে। আমাদের পানিশমেন্ট থাকে - বিয়ে। যার সাথে পড়াশোনার সম্পর্ক হচ্ছে দুই পৃথিবী দূরত্ব প্রায়। কেউ এতোটা পানিশমেন্ট না দিলেও এসব উল্লেখ করতে ভুলে না -

- স্বামীকে মান্য করা ফরজ। অমান্য করা যায় না। (স্বামীর সাথে মূল সম্পর্কটাই হচ্ছে অর্ডার এন্ড ওবেই। মন না চাইলেও কষ্ট করে মানতেই হবে)
- সংসার বড় কঠিন পরীক্ষার জায়গা। 
- বিয়ে তো ছেলেখেলা না। অনেক দায়িত্বের বিষয়। 

আমরা বড় হতে হতে মন-মগজে এ কথাটাই খুব ভালোভাবে গেঁথে যায় যে, বিয়ে এমন একটা জিনিস যার সাথে কঠিন সংসার কঠিনভাবে জড়িত। সংসার কঠিন এক কারাগার, যাতে বিয়ে নামের এক বেড়ী পায়ে পরে ঢুকতে হয়। আর ঐ বেড়ীর অপরপ্রান্ত ধরা থাকে 'স্বামী'র হাতে, যে যখন যা ইচ্ছে অর্ডার করতে পারে, যেটা আমাদের ইচ্ছে না থাকলেও মানতে হবে। যদি না মানতে চাই, থাকবে আল্লাহর লানত। আর যেহেতু শ্বশুরবাড়ির খেদমত করলে স্বামী সন্তুষ্ট থাকবে, এ কারণে বিয়ের সাথে সাথে শ্বশুরবাড়ীর সাথে এডজাস্টমেন্ট এবং রান্না-বান্নাসহ বিভিন্ন কাজের জন্য আফটার অল প্রস্তুত হয়ে যেতে হবে। 

কথাগুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে যতোই সঠিক থাকুক, বাবা-মায়ের আদরে বড় হওয়া, দ্বীনের চর্চা থেকে একটু দূরে থাকা(ইভন দ্বীনের চর্চাযুক্ত ফ্যামিলিগুলোতেও দাম্পত্যের সৌন্দর্যের অংশটুকু সযত্নে আলোচনা থেকে উপেক্ষিত হয়), জীবনে-কিছু-একটা করতে চাওয়া কন্যার কানে সেগুলোকে মোটেই সঠিক এবং গ্রহণযোগ্য মনে হয়না। তার মনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, 'ইসলাম এতো কঠিন কেন?'। সাথে সাথে দাম্পত্য-কলহের সুর, স্বামীর আধিপত্যের সুর প্রতিনিয়ত তার কানে বেজেই যায়। বিয়েটাকে সে কোন অংশেই গ্রহণযোগ্য, অন্তত তার বর্তমান তারুণ্যের সুন্দর সময়ে গ্রহণযোগ্য কিছু বলে মনে করতে পারে না। 

সে মোটামুটি দৃঢ় শপথ নিয়ে নেয় যে, নিজের ভবিষ্যতটুকু সে কোনভাবেই এতো অনাকাঙ্খিতভাবে কাটাবে না। বলা বাহুল্য, এই কন্যাদের অভিভাবকেরাও গ্রহণযোগ্য দাম্পত্য জীবনের সৌন্দর্য হয়তো খুব কমই দেখেছেন। তাই ভালোবাসা বশতঃই তারা কন্যার কানে সহজে বিয়ের কথা তোলেন না। তারা আমাদের সত্যিই ভালোবাসেন, তাই ইসলামপ্রদত্ত কন্যার অনুমতির অংশটুকু তারা ইগনোর করেন না, আমরা না চাইলে তারা চাপিয়ে বিয়ে বসিয়ে দেন না। 'একদিন তো স্বামীর বাড়ি যেতেই হবে, তখন তো চাইলেও অনেক কিছু করতে পারবে না', বিয়ে একেবারে দিবেন না এমনও তো ভাবতে পারেন না, তাই কয়েকটা বছর কন্যাকে কিছুটা নিজের মত করে কাটাতে দেন (হয়তো নিজের চাপা দেওয়া শখ-আহ্লাদের কথা মনে পড়ে যায়)। বিলাসী না হোক, নাজায়েজ না হোক, তাদের জায়েয শখ-আহ্লাদগুলো অপূর্ণ রাখেন না। 

বাবা-মার স্নেহ-আদরে থাকা আমরা স্বভাবতঃই একটা মোটামুটি আনন্দময় জীবন কাটাই। তাই বিয়ে আমাদের কাছে বিভীষিকারই একটা পর্যায়। যেখানে বাবা আমার পছন্দের জিনিসগুলো বাছাই করে আনেন, আমার কষ্ট হবে বলে মা অনেক কাজ থেকেই অব্যাহতি দেন, একটু আবদার করলে চা বানিয়ে দেন, আমাকে হাসতে দেখে খুশি হন; সে জীবন থেকে কষ্টকর বিবাহিত জীবনে পদার্পন করার কোন মানেই থাকে না আমাদের কাছে।

কেমিস্ট্রি-বায়োলজি পড়া, টুকটাক শখের কাজগুলো গুছিয়ে নেওয়া, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবার শখ মনে রেখে সোৎসাহে পড়াশোনা করে যাওয়া আমাদের কানে হঠাৎ যখন বাজে 'মেয়েদের জীবনে স্বামী-সংসারই আসল, সন্তান লালন-পালন করাই তাদের মূল দায়িত্ব' - আমরা আরেকটু বিতৃষ্ণ হয়ে উঠি। পড়ায় আরেকটু মন দিই, নিজ প্রতিজ্ঞায় আরেকটু দৃঢ় হই। 

এত ক্লান্তিকর সংসারে পদার্পণ করা থেকে ফোনে বেজে ওঠা টুং এর জবাবে ছোট করে আরেকটা টাং আমাদের কাছে ঢের সহজ। কেউ যখন বলে - 'এটা ফেতনার সময়, বিয়ে করে নাও। পবিত্র থাকবে, ভালো থাকবে।' - আমরা বক্তার পজিশন অনুসারে হয়তো ইগনোর থাকি, অথবা মুচকি হেসে এড়িয়ে যাই অথবা বিরক্তি প্রকাশ করি।

আমাদের বর্তমান জীবনে তো আল্লাহ অসন্তুষ্ট নন। আল্লাহ আমাদের কিছু আগ্রহ দিয়েছেন, আমরা সেই আগ্রহের চর্চা করি। বাবা-মায়েরা আমাদের উপর তো অসন্তুষ্ট নন, আমাদের ছোট সংসারে আমরা হাসিখুশি থাকি টুকটাক বাবা-মায়ের সাহায্য করি; আর আমাদের লক্ষ্যপূরণে এগিয়ে যাই। এর থেকে সুন্দর জীবন আর কি হতে পারে? এ জীবন ছেড়ে 'বিয়ে' নামের শৃঙ্খল পায়ে পরে, স্বামী নামক আতঙ্ক গ্রহণ করে বাচ্চাধারণ করে পালার আইডিয়া আমাদের কাছে স্রেফ পাগলেরই প্রলাপ।

বিয়ে কি এবং কেন - এসব আমাদের জানার কোন প্রয়োজনই নেই। ঈমানের কম-বেশ অনুসারে, কখনো আমরা টুকটাক সম্পর্ক মেইনটেইন করি, কখনো আমাদের আভিজাত্যের বশে এসব থেকে দূরেই থাকি। তবে অন্তরের গহীন থেকে জানি, এখন না হোক পাঁচ-দশ বছর পর 'বিয়ে' নামক বিভীষিকা আমাদের গ্রহণ করতে হবে, তার জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিতে হবে। 

এভাবে গেঁথে দেওয়া বিরূপ মনোভাবের প্রভাব কি আমাদের দাম্পত্য জীবনে পড়বে না? 

No comments:

Post a Comment