Saturday, November 02, 2024

সে বাস্তবতা, যার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই

খবর আসছে, ইথারে ভাসছে হাহাকার, কান্না। এমন কোন দিন আক্ষরিক অর্থেই পাওয়া যায় না, যেদিন অবৈধ হাতে কোন কোন না শাহাদাহর খবর পাওয়া যায়।

আজ হয়তো আপনার-আমার মতোই রাজনৈতিক আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বললেন, পরিবারের সাথে বন্ধুর সাথে জরুরী আলাপ শেষে ঘুমোতে গেলেন। অথবা বেঁচেই আছেন জীবন্মৃত হয়ে, বাঁচবার ইচ্ছে বা তাকিদ ততটুকুও কাজ করে না, যতটুকু কাজ করে শাহাদাহর প্রেরণা। বিশ্বাসঘাতক একা করে দেওয়া এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার চেয়ে মুক্ত হয়ে যাওয়া হয়তো তাঁর কাছে সত্যিই বহুগুণ শ্রেয়। 

হয়তোবা ঘুমাবার আগেই অথবা আধো-ঘুমের ভিতরই শহীদ হয়ে গেলেন। অথবা জেগেই ছিলেন সন্তানকে বুকে নিয়ে; এই বিশ্বাসঘাতক পৃথিবীর কথা ভাবছিলেন। সন্তানদের নিয়ে তাঁদের কি আর স্বপ্ন জাগে? না-ই বা জাগবে কেন? তাঁদের সন্তানেরাই তো আগামী পৃথিবীর রাহবার হবে, যেমন হয়েছিলেন মুসা আ.। কিন্তু...হয়তো স্বপ্ন বুকে রেখে বাঁচতে চাওয়া, বাঁচাতে চাওয়া মানুষটা...অথবা একবুক দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখা নির্লিপ্ত মানুষটা এক রাতে শহীদ হয়ে গেলেন। 

আমরা এতটুকুই ভাবি, এভাবেই ভাবি; এতোজন শহীদ হয়ে গেলেন।

একটু যদি চোখ বন্ধ করে অনুভব করি, একটু ভিন্নভাবে। যতটুকু সম্ভব! 

সেই মানুষটা আমার মতোই একজন ছিলেন (বা আছেন এখনো, একটু পর হয়তো শাহাদাত বরণ করবেন)। তাঁর জীবনটা আমার মতোই ছিলো। আমার জীবনে যেমন আল্লাহর উপস্থিতি অনুপস্থিতি, আল্লাহর রাসূলের অনুপস্থিতি উপস্থিতি, ইসলামের আদর্শের কম-বেশি ছাপ। তার মাঝেও এমন কিছু ছিল। 

মারা গেলেন। কেন মারা গেলেন? 'কীভাবে' নয়। যদি জিজ্ঞাসা করি, 'কেন' মারা গেলেন? 

সত্য কথা, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সত্য কথা, আপনার-আমার কাছে তিক্ত সত্য - তিনি মারা গেলেন, কারণ তার জীবনের সময় ফুরিয়ে গিয়েছিল, কারণ তাঁর রিজিক ফুরিয়ে গেছে; শ্বাস নেবার রিজিক, খাবার রিজিক, কথা বলার রিজিক, হায়াতের রিজিক। সব ফুরিয়ে গেছে। তাই বিদায় নিয়েছেন। 

কীভাবে বিদায় নিয়েছেন - সেটা ভিন্ন বিষয়। এবং সেটা হয়তোবা অনেকটাই নির্ভর করে মানুষের ইচ্ছা বা নিয়তের উপর; কারো ক্ষেত্রে হয়তো চেষ্টার উপর অথবা অনেক কিছুর উপর... 

আমি-আপনি তো ভাবছি ৫০০ জন মারা গেলেন, ১০০০ জন মারা গিয়েছেন; ২০০০ জন মারা গিয়েছেন। কেউ আফসোস করছেন, একজন প্রখ্যাত শিল্পী মারা গেলো! কেউ কাঁদছেন, হয়তো নিজ সন্তানের দিকে তাঁকিয়ে আরো হাজার সন্তানের ছবি চোখে ভাসছে... 

তাঁদের ঈমান-আক্বীদা-মাকবুলিয়াত-মৃত্যুর সময়ের অবস্থা কোনকিছুই আমরা জায করার যোগ্যতা রাখি না। ঐ পর্যন্ত আমাদের চিন্তা পৌঁছাবার যোগ্যতা, এমনকি হয়তো অধিকারও নেই। 

কিন্তু এবার যদি একটু ভিন্ন দৃশ্যপট থেকে অনুভব করতে যাই - হঠাৎই প্রচন্ড শব্দে মিসাইল আঘাত করলো; সবাই দেখছে আগুনের বিস্ফোরণ, দেখছে বিল্ডিং ধসে পড়া, শুনছে চিৎকার...

যিনি একটু পরেই শহীদের মর্তবা গ্রহণ করবেন - তাঁর কাছে বিষয়টা কেমন থাকে? তিনি কিছুক্ষণ অন্যদের মতোই হয়তোবা সবকিছু দেখেন, শোনেন। তারপর? 

তারপর তাঁর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যটা উপস্থিত হয়। জীবনে, এই রূহের জীবনে, যে বিষয়টা আপনার এবং আমার জন্য সমানভাবে সত্য এবং অনস্বীকার্যভাবে সত্য - তিনি মালাকুল মাওতকে দেখতে পান। যখন তাঁকে দেখেন, নিশ্চিতভাবে জীবনের সবকিছু; এই যে আশেপাশের ভেঙে পড়া, চিৎকার, সন্তানের মৃত্যু বা বাবার মৃত্যু সবকিছু বিলীন হয়ে যায়। সবকিছু থেকে তাঁর কাছে গুরত্ববহ হয়ে যায়, তার কাটিয়ে আসা জীবনটা। জীবনের পথটা। তাঁর ঈমান। তাঁর চিন্তা-ধারা।  

আমরা বলছি ১০০০ প্রাণ। কিন্তু দুনিয়ার সীমানাটা যখন পাড়ি দিয়ে ফেললেন, তাঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব প্রাণটাই তখন চিন্তার বিষয়। তখন ১ এর হিসাব। একটিমাত্র প্রাণের হিসাব। তখন কি এই ইস্যুগুলো আর তাঁদের কাছে ইস্যু থাকে? থাকা সম্ভব? 

যখনই আখেরাতের সীমানায় কেউ পৌঁছে যায়, দুনিয়ার কোন হারজিতই তাঁকে আর ছুঁইতে পারে না। 

এতো মানুষ ইন শা আল্লাহ শহীদের মর্তবায় পৌঁছে গেলেন, কেউ হয়তো মারা গেলেন। কজনের আর খবর আমরা রাখি? 

হয়তো কয়েক যুগ পরে, ধ্বংসস্তুপ থেকে কারো মৃতদেহের অবশিষ্টাংশ বের হবে। সবাই বলাবলি করবে, ২০২৩ সালে ইসরাঈলী হামলার শহীদ...

কিন্তু তিনি তখন? তাঁর কী এসে যায়, এই কয়েক যুগ ধরে কী হল না হলো তাতে? কিছুই না! একদম কিছুই না!

হয়তোবা তাঁর জানাযা হয়নি, নিয়মতান্ত্রিক কবর তো হয়ই নি। তাই বলে কি তাঁর হিসেব-নিকেশ থেমে ছিল; নিশ্চয়ই না! তাঁকেও জবাব দিতে হয়েছে - তাঁর ইলাহ কে ছিল? তাঁর জীবনে আভাস ছিল কার? তাঁর দ্বীন কী ছিল? 

তিনি এখন আর আমাদের কাছে কিছু নন, তিনি পাঁচশ বা একহাজার জনের মধ্যে একজন। কিন্তু আখেরাতে? রবের কাছে? আমাদের রব প্রত্যেকের সাথে আলাদা মুয়ামালা করার সক্ষমতা রাখেন। তাঁকে কেউ ফাঁকি দিতে পারে না। 

যদি শহীদ না হই - বোমার আঘাতে মরলাম, না ঘরের বিছানায়; তাতে কী আসে যায়? যদি শহীদ হই, কিন্তু ঘাড়ের উপর ঋণের বোঝা রেখে?(১) হয়তো, মৃত্যুর পর সবার কাছে আলোচনার বিষয় হয়ে গেলাম; তাতে কী আসবে যাবে, যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না পারি? 

আল্লাহ না করুন, যদি এমন হয়; কবরে কেউ হিন্টস দেবার মতো থাকলো না; আমার জীবনের দিকে তাকিয়ে শুধু একবুক হাহাকার জন্মালো - আল্লাহ না করুন, যদি এমন হয়, তাহলে কীভাবে মারা গেলাম তাতে কী এসে গেলো?

(আল্লাহ করুন, আমাদের ভাইদের বোনদের পূর্ণ শাহাদাতের মর্যাদা দান করুন। তাঁদের অপূর্ণ রাখা যেকোন হক নিজ দায়িত্বে পূর্ণ করে দিন।)

যখন পরিস্থিতি চলে আসে, বরং পরিস্থিতি চলে আসবার আগেই; তার জন্য প্রস্তুতি রাখা - একজন মু'মিনের কর্তব্য, একজন মুসলিমের কর্তব্য, কর্তব্য তাদের সবার - যাদের সামান্যতম সচেতনতা আছে। ভাবনা আছে। 

কিন্তু, ব্যক্তিগত উন্নতি, ব্যক্তিগত মাকবুলিয়াত - নিজ নিজ ক্ষেত্রে সবার ঠিক করে ফেলা প্রয়োজন। রিজিক ফুরিয়ে যাবার আগেই। একবার এই দুনিয়ার সীমানা পার হয়ে গেলে, কীভাবে মারা গেলাম - তাতে তেমন কিছু এসে যাবে না! কীভাবে এর বদলে হয়তোবা 'কী করে' মারা গেলাম - সেটাই বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাবে!

(১৮/১০/২০২৩, কিঞ্চিত পরিমার্জিত) 

(১)  আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত মু’মিনের রূহ্ ঋণের সাথে লটকানো থাকে। - ইবনু মাজাহ ২৪১৩, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ১০৭৮ [হাদিসবিডি]

Thursday, April 18, 2024

তিলাওয়াতুল কুরআন আমামা রব্বানা

রমাদানী আনন্দের অন্যতম উৎস হলো কুরআন! এ আনন্দ বিভিন্নভাবে কুরআনের সাথে কাটাবার আনন্দ!
কুরআনী আনন্দগুলোর মধ্যে অন্যতম আনন্দ হলো - রবের সামনে দাঁড়িয়ে রবকে বেশির চেয়ে বেশি তিলাওয়াত শোনানো। এই অনন্য আনন্দটুকুর জন্যই কি আমাদের রব রামাদানে তারাবীহকে জরুরী করে দেননি? সিয়াম উপলক্ষে যে অবসরটুকু পাই, তা কাজে লাগিয়ে ভিন্ন এক স্বাদে নিমগ্ন হবার জন্যই নয় কি? 

অথচ বাস্তবতা হলো, তারাবীহ আমাদের কাছে বাড়তি বোঝার মতো বোধ হয়। কোনভাবে তারাবীহ শেষ করে 'ফ্রি' হতে পারলেই আমাদের নির্ভার লাগে। আফসোস, তারাবীহে দীর্ঘসময় নিমগ্ন তিলাওয়াতের স্বাদ থেকে আমরা বঞ্চিতই রয়ে গেলাম! 

বিশেষত হিফয থাকার পরও বৎসরে মাত্র একবার আসা এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়া কতোই না কষ্টের! এর পিছনে বাহ্যিক কারণগুলো বাদ দিলেও আরও নিজেদের কিছু গাফলতিও কাজ করে - আমাদের হিফযের দূর্বলতা, যার কারণে পুনঃইয়াদ না করে বা এক-দু বার দেখে না পড়ে সালাতে পড়তে পারি না। অথচ এর জন্য যে সময়টুকুর প্রয়োজন, রামাদানের অন্যান্য ব্যস্ততা, ক্লান্তির মাঝে ঐ মনোযোগ বা সময়টুকু প্রায়ই দিয়ে ওঠা হয় না। অবশেষে সালাতে তিলাওয়াতের অতুলনীয় স্বাদ থেকে বঞ্চিত থেকে যাই।

আরেকটা বিষয় আমরা লক্ষ্য করেছি কি? আমরা যথারীতি হিফয করি, কুরআনের ভাষাশিক্ষায় মশগুল হতে চাই - তবু বারংবার তাল নষ্ট হয়ে যায়, গতি মন্থর হয়ে যায়। প্রায়শই আমরা আমাদের মেহনত থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই! হিফযের ক্ষেত্রে তো রিভিশন এর সময় পাইনা, তাই ইয়াদ করা অংশগুলো ভুলে যেতে থাকি। সেগুলোই পুনঃইয়াদ করা হয়ে ওঠে না, নতুন ইয়াদ আর কখন করবো!
এ ছাড়া হিফযের মেহনতে থাকলে সালাতে তিলাওয়াতের যতোটুকু ইচ্ছে ও আগ্রহ কাজ করে, যখন আমরা হিফয থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই তার কতোটুকুই বা আর বেঁচে থাকে?
আর কিয়ামুল লাইলের প্রতি গাফলতির কথা উহ্যই করে যাই বরং! 

সবকিছুর পিছনে কোন বিষয়টা কাজ করে বলুন! 

আমার তো মনে হয়, এটি ছাড়া আর কোন কারণই নেই যে আমরা আমাদের রবের সামনে তিলাওয়াতের স্বাদটুকু ভুলে গিয়েছি, অথবা মোটেই পাইনি। বছরে ঠিক কতোবার এমন হয় যে, আমরা সালাতে আমাদের রব আল্লাহ জাল্লা জালালুহুকে তিলাওয়াত করে শুনাচ্ছি আর আয়াতের গভীরতায়, ভারে কাঁদছি!

বোনেরা, আমরা তো মূল আনন্দটুকুই হারিয়ে ফেলেছি! এ কারণে হিফয করা হোক বা কুরআন বোঝার মেহনত, অথবা কিয়ামুল লাইল - সবকিছু থেকেই বারংবার পিছলে যাচ্ছি! মাহরূম হয়ে যাচ্ছি। 

কোন স্বাদে হুযুর সা. সালাত পড়তে পড়তে পা ফুলিয়ে ফেলতেন! সূরার পর সূরা তিলাওয়াত করে যেতেন! জুয এর পর জুযের সফর শেষ করতেন! কোন স্বাদে আমাদের সালাফেরা এক কি দুটি আয়াত পড়তে পড়তে রাত পার করে দিতেন! আমরা তো তার ছোঁয়া থেকেই বহুদূর!


সূরা মুযযাম্মিলে আল্লাহ তা'আলার এই আহবানগুলো কি আমাদের অন্তর টানে না - 

يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ (١) قُمِ اللَّيْلَ إِلا قَلِيلا (٢) نِصْفَهُ أَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِيلا (٣) أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلا (٤)
হে বস্ত্রাবৃত! রাতে দন্ডায়মান থাকুন, কিছু অংশ ছাড়া; (দন্ডায়মান থাকুন) - আধা রাত, অথবা তা থেকে কিছুটা কমান, কিংবা তার চেয়ে বাড়িয়ে নিন এবং কুরআন পাঠ করুন ধীরে ধীরে স্পষ্ট করে।  (মুযযাম্মিল ১-৪) 

দেখুন, তিনি আবারো ডাকছেন একই সূরায় -

عَلِمَ أَن لَّن تُحْصُوهُ فَتَابَ عَلَيْكُمْ ۖ فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ ۚ عَلِمَ أَن سَيَكُونُ مِنكُم مَّرْضَىٰ ۙ وَآخَرُونَ يَضْرِبُونَ فِي الْأَرْضِ يَبْتَغُونَ مِن فَضْلِ اللَّهِ ۙ وَآخَرُونَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۖ فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ ۚ
তিনি জানেন যে, তোমরা তার (অর্থাৎ সময়ের) সঠিক হিসাব রাখতে পারবে না, সুতরাং তিনি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। এখন কুরআন থেকে ততটুকুই পড়, যতটুকু সহজ হয়। তিনি জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কতক অসুস্থ হবে, আর কিছু সংখ্যক যারা যমীনে ভ্রমণ করবে আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে, আর কিছু লোক থাকবে, যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধরত থাকবে। অতএব কুরআন থেকে যতটুকু সহজ হয় ততটুকুই পড়।

চলুন না, আজ নিয়ত করি আমরা নিজেদের এই কুরআন বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে তুলে আনবো। যতটুকুই আল্লাহ হিফয করার তৌফিক দিয়েছেন, তার মধ্যে যতটুকুই সহজ হয়, ততটুকু আমরা আমাদের সালাতে জারি করে নেবো রামাদান আবারও আমাদের কাজে পৌঁছে যাবার আগে, ইনশাআল্লাহ! আগামী রামাদান হোক না আরেকটু জৌলুসপূর্ণ! আমাদের কিয়ামুল লাইল জীবন্ত হয়ে উঠুক প্রাণবন্ত আন্তরিক মুহাব্বাতের তিলাওয়াতে! 
কীভাবে আমরা আমাদের সালাতে কুরআনকে জারি করতে পারি?

এজন্য আমরা এখন থেকেই সচেতনভাবে সালাতে কুরআনকে বাড়াতে থাকবো ইনশাআল্লাহ। পাশাপাশি চেষ্টা করবো, নিজ নিজ সামর্থ্য অনুসারে কুরআনী শব্দার্থের ভান্ডারও বাড়াতে থাকার; কুরআনী ভাষাশিক্ষার মেহনত তো থাকবেই। আল্লাহর রহমত যদি শামিল হয়, আল্লাহ যদি অবশেষে আবারও রামাদান পর্যন্ত পৌঁছে দেন, ইনশাআল্লাহ একটি নতুন সফর শেষে রামাদানকে নতুনভাবে অনুভবের সুযোগ হবে। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন।
এ ব্যাপারে খসড়া একটা পরিকল্পনা সামনে রাখা হলো। এই তালিকাটি ত্রিশ পারার সূরা দুহা থেকে শুরু করা হয়েছে, যেহেতু হিফযের ক্ষেত্রে এগুলো অগ্রাধিকার পায়।

তালিকাটি করার ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয়েছে যে, ঐ বোনের এই সূরাগুলো মুখস্থ আছে তবে তাঁর সালাতে এগুলো তিলাওয়াত করে অভ্যাস নেই। বোনেরা একে নিজেদের অভ্যাস ও হিফয অনুসারে কম-বেশি করে নিতে পারেন। কেউ চাইলে এক পৃষ্ঠা, বা একটি রুকু, দুটি ছোট সূরা অথবা একটি বড় সূরাও রাখতে পারেন। তবে প্রথম প্রথম কম হলেই ভালো। 'আল্লাহর কাছে ঐ আমলটিই প্রিয় যা অল্প কিন্তু নিয়মিত হয়'।

এই অংশটুকু শেষ হলে ক্রমান্বয়ে হিফযে থাকা অন্যান্য অংশগুলো নিয়ে এভাবে তালিকা প্রস্তুত করে তিলাওয়াত করতে থাকতে হবে। এ ব্যাপারে কয়েকটা বিষয় লক্ষ্য করিঃ

১। তিলাওয়াতুস স্বলাহ এর জন্য আলাদা একটি নোটবুক বা ডায়েরী প্রস্তুত করে নিলে খুবই ভালো হয়। এতে বিষয়টির গুরত্ব বাড়বে। যদি ডায়েরীটিকে নিজের মতো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে তো আর কথাই নেই! 
কেমন হবে, যদি একদিন ডায়েরীটির পাতার পর পাতা ভরে যায় এ কারণে যে, আপনার হিফযের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং সালাতে তিলাওয়াতের পরিমাণও একই সাথে বেড়েই চলেছে! সুবহানাল্লাহ!

২। এই পরিকল্পনা অনুসারে, আমার তালিকায় আমি যতটুকু করে পড়বো ততটুকু লিখে তালিকা করে ফেলবো। যেদিন যে অংশটি পড়বে, প্রতিদিনের সালাতে ঐ অংশটি আমার নিয়মিত পড়া সূরাগুলোর সাথে বারংবার পড়তে থাকবো। প্রতি ওয়াক্তে অন্তত একবার যেন পড়া হয়। 
এই নির্দিষ্ট অংশটুকু বোনেদের নিজ নিজ হিফয অনুসারে কম-বেশি হবে।

৩। নির্দিষ্ট অংশটি প্রতিদিন যতবার পড়বো, তত সংখ্যাটি 'দৈনিক পড়া' টালি বা টিকচিহ্ন দিয়ে রেকর্ড রাখবো। 

৪। এভাবে কিছু অংশ পড়া হলে, যেমন পারার এক চতুর্থাংশ পড়া হলে অথবা কোন বড় সূরা শেষ হলে তা সপ্তাহজুড়ে টানা পড়তে থাকবো। সপ্তাহজুড়ে পড়ার সময় যতবার কোন অংশ পড়া হচ্ছে তাও লিপিবদ্ধ রাখতে পারি 'সাপ্তাহিক পড়া' ঘরে।

৫। সপ্তাহশেষে আবারও নতুন অংশের তিলাওয়াতে যাবো, এবং একইভাবে লিপিবদ্ধ রাখবো।  তবে এবার যখন পুনরাবৃত্তির সপ্তাহ আসবে, আগের অংশটুকুসহ এবার পুনরাবৃত্তি করবো।

৬। এভাবে একাধিক পারা শেষ হয়ে এলে প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্তের প্রতি রাকাতে ভিন্ন ভিন্ন অংশ তিলাওয়াত করবো।

৭। কারো কাছে বারংবার আপডেট করাও 'বাড়তি কাজ' মনে হতে পারে, তারা ডায়েরী কলমসহ জায়নামাজের কাছেই রেখে দিবো, সালাত শেষে অথবা দিনে অন্তত একবার আপডেট করবো।

৮। এছাড়া আরো তিনটি কলাম রাখা হয়েছে- শব্দার্থ, তরজমা, তাফসীর। এগুলো ঐচ্ছিক কলাম। যখন কুরআনের কোন অংশের শব্দার্থ শেখা, তরজমা বা তাফসীর পড়া শেষ হবে, এখানে তার রেকর্ড রেখে দিতে পারি। বছরশেষে পাতা উল্টিয়ে নিজের অবস্থান বুঝতে পারবো।

এটি একটি পূর্ণ পরিকল্পনা। কারো কাছে ভারী মনে হলে এটাকে সামনে রেখে নিজের সুবিধা ও সামর্থ্য অনুসারে কম-বেশি করে নিতে পারি।

আল্লাহ যদি সত্যিই তৌফিক দিন - আমরা আমাদের সালাতের স্বাদ কিছুটা হলেও ফিরে পাবো,  ইনশাআল্লাহ। সালাতের প্রতি আগ্রহ, কিয়ামুল লাইলে উঠবার উদ্দীপনা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাবে। যখন একটু একটু বুঝে পড়তে শিখবো, একটু কাঁদতে শিখবো; পুরো কুরআন বুঝে ফেলবার তড়প চলে আসবে ইনশাআল্লাহ!

আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন, ভরপুর তৌফিক দিন! 

Friday, January 12, 2024

ইতিহাসের পাতায় - ১২/০১ /২৪

 ইতিহাসের পাতায় আজকের দিনটা কেমন হতে পারে? জানিনা, তবে আজ আমার জন্য মোটামুটি গুরত্বপূর্ণ উপলদ্ধির দিবস। 

কেন জানি না, আজকেই অনেকগুলো গুরত্বপূর্ণ বিষয় একসাথে চোখের সামনে চলে এলো। বেশ কিছু সুতো মিলে যেতে থাকলো। জানি না কেন। কয়েক সপ্তাহ ধরেই, গত শতাব্দীর ইতিহাস পড়া/বোঝাটা খুব বেশি গুরত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। যতো দিন যাচ্ছে, এই অনুভূতি আরো তীব্র হচ্ছে।

নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মজীবনী ধরনের একটা বই ধরেছিলাম পড়তে। অনুবাদ বলেই কি না, বেশি এগুতে পারিনি। আজ মাওলানা আতিক উল্লাহর দারস শুনতে শুনতে আবারো উজ্জীবিত হতে হলো। আজ অন্য বেশ কিছু কাজ লিস্টে ছিল, সব ফেলে মন দিয়ে কিছু নিউজ ফলোআপ করলাম। অন্যসময় অনুভব হয়, সময় বেশ কিছুটা নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু এখন জেনে-থাকাটা খুব, খুব বেশি গুরত্বপূর্ণ মনে হয়। 

যাই হোক, মূল কথায় আসি।

আফ্রিকা, পীড়িত-নিপীড়িত আফ্রিকা ICJ অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত এ ইসরাইলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। মামলা সম্পর্কে যারা জানি, স্বভাবত নিরাশবোধ করতেই পারি। বিশেষত আন্তর্জাতিক আইন, মামলা ইত্যাদি কার অধীনে সবাই কম-বেশি জানি এবং এই মামলার শেষ পরিণতি কী হবে তাও জানা। এছাড়া যা বুঝলাম, এ ধরনের মামলা শেষ হতে হতে বছরও পেরিয়ে যায়; সুতরাং আফ্রিকা যে জন্য মামলা দায়ের করেছে সেটা কিছুটা অর্থহীন এ পৌঁছে যেতে পারে।

কিন্তু, দক্ষিণ আফ্রিকা সব যুক্তিতর্ক ঠেলে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েছে, ভালোভাবে মামলা তুলে ধরেছে। এটা অবশ্যই বর্তমান সময়ের জন্য খুবই গুরত্বপূর্ণ একটা পদক্ষেপ এবং জাতিগত শক্তি ও সাহসের পরিচায়ক। ইসরাইল ও তার দোস্তদের অল্প পরিসরে হলেও জবাবদিহিতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। অলরেডি শুনানি শুরু হয়েছে। যদিও কী বলবে মোটামুটি আন্দাজ করা যায়, তবু মোটামুটি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। 

আরো মজার বিষয় হচ্ছে, ইসরাইলী সৈন্যরা সব নীতি ভঙ্গ করে যা কিছু করেছে, সব কিছুর স্বহস্ত-প্রমাণ রেখে দিয়েছে। এতদিন তো সবই হেলায় করেছে, কিন্তু আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য এই প্রমাণগুলো্র খুব দরকার ছিলো। 

আজকে উস্তাদ আতিকুল্লাহ আলোচনায় এটাও বললেন, কুরআনেই আছে, তারা খুব সহজে উস্কে উঠে। ওদের দিকে একটু হাত তোলা সহ্য করতে পারে না। গাজা-লেবানন-ইয়েমেন আরো সব বিষয়ে এই মামলা ওদের কী পরিমাণ জ্বলুনি তৈরি করেছে তার ইফেক্ট দেখতে সত্যিই অপেক্ষা করতে মন চাচ্ছে না। 

(লেখায় গ্যাপ পড়ে যাওয়ায় তাল পাচ্ছি না) 

দ্বিতীয় গুরত্বপূর্ণ খবরটা হলো, ইয়েমেন। এতদিন হুথিদের খবরগুলো টুকটাক পড়ছিলাম, অত মনোযোগ দিচ্ছিলাম না। শুধুমাত্র সমুদ্রপথ আটকে দিয়ে হুথিরা গাজার বড় সাহায্য করেছে। 

কেমন সাহায্য করেছে, বা ইসরাইল সহ তার মিত্রদের কেমন ক্ষতি করেছে সেটা বোঝা যায় এই আক্রমণের বহর থেকেই। শুধুমাত্র ইসরাইল বা আমেরিকা না; লটবহর নিয়ে অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, বাহরাইন - এতগুলো দেশের যৌথ আক্রমণ হয়েছে। এবং সেটা তারা তাদের অফিসিয়াল একাউন্টে পরিষ্কার টুইট করেছে। এটাও দাবি করেছে যে, কোন মানুষ মারা যায়নি। 

কোন পর্যায়ে কোনঠাসা হলে একটা দেশের উপর এতগুলো দেশ ঝাঁপিয়ে পড়ে? তাদের দাবি অনুসারে যদি  সত্যিই কোন মানুষ না মারা গিয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে খুব সতর্কতার সাথে আক্রমণ করেছে। এই সতর্কতার মানে কী? ইসরাইল আক্রমণে বিশ্ব-পরিস্থিতিই প্রকাশ করে তাদের সতর্কতার প্রয়োজন।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এটাকেও আত্মরক্ষামূলক আক্রমণ বলেছে। হাহা। 

আর দু-একটা বিষয় নোট করার মত মনে হয়েছেঃ
১। ওমান। সে তার আকাশপথকে ইয়েমেনে আক্রমণের জন্য ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
২। সৌদি। সে যা করার কথা করেছে, আক্রমণকে সাপোর্ট করেছে এবং খুব সম্ভবত সরাসরি আক্রমণ না করলেও সাহায্য করেছে। 
৩। বাহরাইন। গাদ্দারের লিস্টে চোখে পড়া নতুন নাম।

ইয়েমেন আক্রমণের সাথে সাথে সে দৃঢ়তা প্রকাশ করে বলেছে, আমরা গাযানদের সাহায্য করা থেকে বিরত থাকবো না। এবং বারংবার গাযার প্রসঙ্গ তুলে এনেছে। এখন ইয়েমেনি জনগণের মানসিকতা খুবই গুরত্বপূর্ণ। যদি তারাও এমন দৃঢ়তা প্রকাশ করতে পারে (অলরেডি একজনকে দেখলাম), তাহলে ইয়েমেন খুব গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে ইনশাআল্লাহ। [এখানে কূটনৈতিক টুকটাক কিছু ব্যাপার থাকতে পারে, কিন্তু এতগুলো আক্রমণ সয়ে কোন দেশ কীভাবে ভুয়া সহমর্মিতা দেখাতে পারে; এটা অসম্ভব ই মনে হচ্ছে। দেখা যাক সামনে।]

৩ 

উস্তাদ আতিকুল্লাহ আরেকটা গুরত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। কয়েকদিন আগে এক আলোচনায় আমি বলছিলাম, গাযার যেমন ইসরাইল আছে আমাদেরও কিছু একটা আছে। আজকে উস্তাদ বললেন, ইহুদিদের সবচেয়ে কাছাকাছি হলো মুশরিকরা। আর এখন এর প্রকাশ্য নিদর্শন ও কার্যক্রম দেখাও আমাদের বাকি নেই। 

এখন আমাদের জন্য খুব জরুরী হলো, ইসরাইলী পদক্ষেপগুলো পর্যবেক্ষণ করা, বোঝা। এখানে পুরুষ-নারী ভেদ নেই। তারা পুরুষ-নারী ভেদ করে না। ফ্রন্ট চেনে না। নাগরিক চেনে না। ওদের কোন নীতি নেই। এখানে আমরা যত নিজেদের ভেদ করে নিজেদের অসচেতন করে রাখবো, তত নিজেদের এবং নিজেদের সন্তানদের ভোগান্তির জন্য তৈরি করে রাখবো। 

গত কয়েকদিনে হাতে আসা ১-২ টা বইয়ে গত শতাব্দীর দেশগুলোর যুদ্ধ-সংঘাতের যে চিত্র চোখে পড়েছে; তাতে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট মনে হয়েছে - প্রতিটি সংঘাতের সাথে ফিলিস্তিন কোন না কোনভাবে জড়িত। আমাদের বিজয়ে যারা অগ্রবর্তী ছিলেন, তারা অন্যান্য দেশে যদিও কাজ করেছেন, কিন্তু বারংবার ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ তাঁদের কথায় ছিলো, আলোচনায় ছিলো। ঐ সময়ে ফিলিস্তিনি যে চিত্রগুলোর বর্ণনা পাই, বর্তমান ফিলিস্তিনের চিত্র যেন প্রায় একইরকম। অর্থাৎ এখন আমরা যা দেখছি, অনুভব করছি; এটাই ফিলিস্তিনিরা এবং ঐ সময়কার সচেতন মুসলিম বা নেতারা অনুভব করছিলেন। গত শতাব্দীতে ফিলিস্তিনিরা এভাবেই নিপীড়িত হয়েছে, যেমন এখন হচ্ছে। 

তবে একটা পার্থক্য মনে হয়, ঐসময়ে জাতিগতভাবে পাশে দাঁড়ানোর মত খুব বেশি কেউ ছিল না (আমার জ্ঞান অনুসারে)। এখন আমরা যথেষ্ট গাদ্দারি দেখতে পাচ্ছি। পাশাপাশি আলহামদুলিল্লাহ্‌, পাশে দাঁড়ানোর মত কিছু দেশ দেখছি, কিছু কথা শুনছি। যেহেতু বিজয় সংখ্যা দিয়ে আসে না, দেশ ও শক্তি দিয়ে আসে না এবং বিজয়ের কৃতিত্ব আল্লাহ ইনশাআল্লাহ যোগ্য হাতেই দিবেন, তাই খুব ভরসা করতেই পারি তাঁর উপর। 

গত শতাব্দীতে একটানা মুসলিম নিপীড়নের হাহাকার ই ভেসে ওঠে। কিন্তু কে জানে, হয়তো বা একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকটি আমাদের বিজয়ের? 

বাকি আমাদের খুব দ্রুত সচেতন হয়ে যাওয়া এবং দুয়া, খুব দুয়া।