Thursday, April 18, 2024

তিলাওয়াতুল কুরআন আমামা রব্বানা

রমাদানী আনন্দের অন্যতম উৎস হলো কুরআন! এ আনন্দ বিভিন্নভাবে কুরআনের সাথে কাটাবার আনন্দ!
কুরআনী আনন্দগুলোর মধ্যে অন্যতম আনন্দ হলো - রবের সামনে দাঁড়িয়ে রবকে বেশির চেয়ে বেশি তিলাওয়াত শোনানো। এই অনন্য আনন্দটুকুর জন্যই কি আমাদের রব রামাদানে তারাবীহকে জরুরী করে দেননি? সিয়াম উপলক্ষে যে অবসরটুকু পাই, তা কাজে লাগিয়ে ভিন্ন এক স্বাদে নিমগ্ন হবার জন্যই নয় কি? 

অথচ বাস্তবতা হলো, তারাবীহ আমাদের কাছে বাড়তি বোঝার মতো বোধ হয়। কোনভাবে তারাবীহ শেষ করে 'ফ্রি' হতে পারলেই আমাদের নির্ভার লাগে। আফসোস, তারাবীহে দীর্ঘসময় নিমগ্ন তিলাওয়াতের স্বাদ থেকে আমরা বঞ্চিতই রয়ে গেলাম! 

বিশেষত হিফয থাকার পরও বৎসরে মাত্র একবার আসা এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়া কতোই না কষ্টের! এর পিছনে বাহ্যিক কারণগুলো বাদ দিলেও আরও নিজেদের কিছু গাফলতিও কাজ করে - আমাদের হিফযের দূর্বলতা, যার কারণে পুনঃইয়াদ না করে বা এক-দু বার দেখে না পড়ে সালাতে পড়তে পারি না। অথচ এর জন্য যে সময়টুকুর প্রয়োজন, রামাদানের অন্যান্য ব্যস্ততা, ক্লান্তির মাঝে ঐ মনোযোগ বা সময়টুকু প্রায়ই দিয়ে ওঠা হয় না। অবশেষে সালাতে তিলাওয়াতের অতুলনীয় স্বাদ থেকে বঞ্চিত থেকে যাই।

আরেকটা বিষয় আমরা লক্ষ্য করেছি কি? আমরা যথারীতি হিফয করি, কুরআনের ভাষাশিক্ষায় মশগুল হতে চাই - তবু বারংবার তাল নষ্ট হয়ে যায়, গতি মন্থর হয়ে যায়। প্রায়শই আমরা আমাদের মেহনত থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই! হিফযের ক্ষেত্রে তো রিভিশন এর সময় পাইনা, তাই ইয়াদ করা অংশগুলো ভুলে যেতে থাকি। সেগুলোই পুনঃইয়াদ করা হয়ে ওঠে না, নতুন ইয়াদ আর কখন করবো!
এ ছাড়া হিফযের মেহনতে থাকলে সালাতে তিলাওয়াতের যতোটুকু ইচ্ছে ও আগ্রহ কাজ করে, যখন আমরা হিফয থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই তার কতোটুকুই বা আর বেঁচে থাকে?
আর কিয়ামুল লাইলের প্রতি গাফলতির কথা উহ্যই করে যাই বরং! 

সবকিছুর পিছনে কোন বিষয়টা কাজ করে বলুন! 

আমার তো মনে হয়, এটি ছাড়া আর কোন কারণই নেই যে আমরা আমাদের রবের সামনে তিলাওয়াতের স্বাদটুকু ভুলে গিয়েছি, অথবা মোটেই পাইনি। বছরে ঠিক কতোবার এমন হয় যে, আমরা সালাতে আমাদের রব আল্লাহ জাল্লা জালালুহুকে তিলাওয়াত করে শুনাচ্ছি আর আয়াতের গভীরতায়, ভারে কাঁদছি!

বোনেরা, আমরা তো মূল আনন্দটুকুই হারিয়ে ফেলেছি! এ কারণে হিফয করা হোক বা কুরআন বোঝার মেহনত, অথবা কিয়ামুল লাইল - সবকিছু থেকেই বারংবার পিছলে যাচ্ছি! মাহরূম হয়ে যাচ্ছি। 

কোন স্বাদে হুযুর সা. সালাত পড়তে পড়তে পা ফুলিয়ে ফেলতেন! সূরার পর সূরা তিলাওয়াত করে যেতেন! জুয এর পর জুযের সফর শেষ করতেন! কোন স্বাদে আমাদের সালাফেরা এক কি দুটি আয়াত পড়তে পড়তে রাত পার করে দিতেন! আমরা তো তার ছোঁয়া থেকেই বহুদূর!


সূরা মুযযাম্মিলে আল্লাহ তা'আলার এই আহবানগুলো কি আমাদের অন্তর টানে না - 

يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ (١) قُمِ اللَّيْلَ إِلا قَلِيلا (٢) نِصْفَهُ أَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِيلا (٣) أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلا (٤)
হে বস্ত্রাবৃত! রাতে দন্ডায়মান থাকুন, কিছু অংশ ছাড়া; (দন্ডায়মান থাকুন) - আধা রাত, অথবা তা থেকে কিছুটা কমান, কিংবা তার চেয়ে বাড়িয়ে নিন এবং কুরআন পাঠ করুন ধীরে ধীরে স্পষ্ট করে।  (মুযযাম্মিল ১-৪) 

দেখুন, তিনি আবারো ডাকছেন একই সূরায় -

عَلِمَ أَن لَّن تُحْصُوهُ فَتَابَ عَلَيْكُمْ ۖ فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ ۚ عَلِمَ أَن سَيَكُونُ مِنكُم مَّرْضَىٰ ۙ وَآخَرُونَ يَضْرِبُونَ فِي الْأَرْضِ يَبْتَغُونَ مِن فَضْلِ اللَّهِ ۙ وَآخَرُونَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۖ فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ ۚ
তিনি জানেন যে, তোমরা তার (অর্থাৎ সময়ের) সঠিক হিসাব রাখতে পারবে না, সুতরাং তিনি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। এখন কুরআন থেকে ততটুকুই পড়, যতটুকু সহজ হয়। তিনি জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কতক অসুস্থ হবে, আর কিছু সংখ্যক যারা যমীনে ভ্রমণ করবে আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে, আর কিছু লোক থাকবে, যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধরত থাকবে। অতএব কুরআন থেকে যতটুকু সহজ হয় ততটুকুই পড়।

চলুন না, আজ নিয়ত করি আমরা নিজেদের এই কুরআন বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে তুলে আনবো। যতটুকুই আল্লাহ হিফয করার তৌফিক দিয়েছেন, তার মধ্যে যতটুকুই সহজ হয়, ততটুকু আমরা আমাদের সালাতে জারি করে নেবো রামাদান আবারও আমাদের কাজে পৌঁছে যাবার আগে, ইনশাআল্লাহ! আগামী রামাদান হোক না আরেকটু জৌলুসপূর্ণ! আমাদের কিয়ামুল লাইল জীবন্ত হয়ে উঠুক প্রাণবন্ত আন্তরিক মুহাব্বাতের তিলাওয়াতে! 
কীভাবে আমরা আমাদের সালাতে কুরআনকে জারি করতে পারি?

এজন্য আমরা এখন থেকেই সচেতনভাবে সালাতে কুরআনকে বাড়াতে থাকবো ইনশাআল্লাহ। পাশাপাশি চেষ্টা করবো, নিজ নিজ সামর্থ্য অনুসারে কুরআনী শব্দার্থের ভান্ডারও বাড়াতে থাকার; কুরআনী ভাষাশিক্ষার মেহনত তো থাকবেই। আল্লাহর রহমত যদি শামিল হয়, আল্লাহ যদি অবশেষে আবারও রামাদান পর্যন্ত পৌঁছে দেন, ইনশাআল্লাহ একটি নতুন সফর শেষে রামাদানকে নতুনভাবে অনুভবের সুযোগ হবে। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন।
এ ব্যাপারে খসড়া একটা পরিকল্পনা সামনে রাখা হলো। এই তালিকাটি ত্রিশ পারার সূরা দুহা থেকে শুরু করা হয়েছে, যেহেতু হিফযের ক্ষেত্রে এগুলো অগ্রাধিকার পায়।

তালিকাটি করার ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয়েছে যে, ঐ বোনের এই সূরাগুলো মুখস্থ আছে তবে তাঁর সালাতে এগুলো তিলাওয়াত করে অভ্যাস নেই। বোনেরা একে নিজেদের অভ্যাস ও হিফয অনুসারে কম-বেশি করে নিতে পারেন। কেউ চাইলে এক পৃষ্ঠা, বা একটি রুকু, দুটি ছোট সূরা অথবা একটি বড় সূরাও রাখতে পারেন। তবে প্রথম প্রথম কম হলেই ভালো। 'আল্লাহর কাছে ঐ আমলটিই প্রিয় যা অল্প কিন্তু নিয়মিত হয়'।

এই অংশটুকু শেষ হলে ক্রমান্বয়ে হিফযে থাকা অন্যান্য অংশগুলো নিয়ে এভাবে তালিকা প্রস্তুত করে তিলাওয়াত করতে থাকতে হবে। এ ব্যাপারে কয়েকটা বিষয় লক্ষ্য করিঃ

১। তিলাওয়াতুস স্বলাহ এর জন্য আলাদা একটি নোটবুক বা ডায়েরী প্রস্তুত করে নিলে খুবই ভালো হয়। এতে বিষয়টির গুরত্ব বাড়বে। যদি ডায়েরীটিকে নিজের মতো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে তো আর কথাই নেই! 
কেমন হবে, যদি একদিন ডায়েরীটির পাতার পর পাতা ভরে যায় এ কারণে যে, আপনার হিফযের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং সালাতে তিলাওয়াতের পরিমাণও একই সাথে বেড়েই চলেছে! সুবহানাল্লাহ!

২। এই পরিকল্পনা অনুসারে, আমার তালিকায় আমি যতটুকু করে পড়বো ততটুকু লিখে তালিকা করে ফেলবো। যেদিন যে অংশটি পড়বে, প্রতিদিনের সালাতে ঐ অংশটি আমার নিয়মিত পড়া সূরাগুলোর সাথে বারংবার পড়তে থাকবো। প্রতি ওয়াক্তে অন্তত একবার যেন পড়া হয়। 
এই নির্দিষ্ট অংশটুকু বোনেদের নিজ নিজ হিফয অনুসারে কম-বেশি হবে।

৩। নির্দিষ্ট অংশটি প্রতিদিন যতবার পড়বো, তত সংখ্যাটি 'দৈনিক পড়া' টালি বা টিকচিহ্ন দিয়ে রেকর্ড রাখবো। 

৪। এভাবে কিছু অংশ পড়া হলে, যেমন পারার এক চতুর্থাংশ পড়া হলে অথবা কোন বড় সূরা শেষ হলে তা সপ্তাহজুড়ে টানা পড়তে থাকবো। সপ্তাহজুড়ে পড়ার সময় যতবার কোন অংশ পড়া হচ্ছে তাও লিপিবদ্ধ রাখতে পারি 'সাপ্তাহিক পড়া' ঘরে।

৫। সপ্তাহশেষে আবারও নতুন অংশের তিলাওয়াতে যাবো, এবং একইভাবে লিপিবদ্ধ রাখবো।  তবে এবার যখন পুনরাবৃত্তির সপ্তাহ আসবে, আগের অংশটুকুসহ এবার পুনরাবৃত্তি করবো।

৬। এভাবে একাধিক পারা শেষ হয়ে এলে প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্তের প্রতি রাকাতে ভিন্ন ভিন্ন অংশ তিলাওয়াত করবো।

৭। কারো কাছে বারংবার আপডেট করাও 'বাড়তি কাজ' মনে হতে পারে, তারা ডায়েরী কলমসহ জায়নামাজের কাছেই রেখে দিবো, সালাত শেষে অথবা দিনে অন্তত একবার আপডেট করবো।

৮। এছাড়া আরো তিনটি কলাম রাখা হয়েছে- শব্দার্থ, তরজমা, তাফসীর। এগুলো ঐচ্ছিক কলাম। যখন কুরআনের কোন অংশের শব্দার্থ শেখা, তরজমা বা তাফসীর পড়া শেষ হবে, এখানে তার রেকর্ড রেখে দিতে পারি। বছরশেষে পাতা উল্টিয়ে নিজের অবস্থান বুঝতে পারবো।

এটি একটি পূর্ণ পরিকল্পনা। কারো কাছে ভারী মনে হলে এটাকে সামনে রেখে নিজের সুবিধা ও সামর্থ্য অনুসারে কম-বেশি করে নিতে পারি।

আল্লাহ যদি সত্যিই তৌফিক দিন - আমরা আমাদের সালাতের স্বাদ কিছুটা হলেও ফিরে পাবো,  ইনশাআল্লাহ। সালাতের প্রতি আগ্রহ, কিয়ামুল লাইলে উঠবার উদ্দীপনা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাবে। যখন একটু একটু বুঝে পড়তে শিখবো, একটু কাঁদতে শিখবো; পুরো কুরআন বুঝে ফেলবার তড়প চলে আসবে ইনশাআল্লাহ!

আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন, ভরপুর তৌফিক দিন! 

No comments:

Post a Comment