খবর আসছে, ইথারে ভাসছে হাহাকার, কান্না। এমন কোন দিন আক্ষরিক অর্থেই পাওয়া যায় না, যেদিন অবৈধ হাতে কোন কোন না শাহাদাহর খবর পাওয়া যায়।
আজ হয়তো আপনার-আমার মতোই রাজনৈতিক আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বললেন, পরিবারের সাথে বন্ধুর সাথে জরুরী আলাপ শেষে ঘুমোতে গেলেন। অথবা বেঁচেই আছেন জীবন্মৃত হয়ে, বাঁচবার ইচ্ছে বা তাকিদ ততটুকুও কাজ করে না, যতটুকু কাজ করে শাহাদাহর প্রেরণা। বিশ্বাসঘাতক একা করে দেওয়া এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার চেয়ে মুক্ত হয়ে যাওয়া হয়তো তাঁর কাছে সত্যিই বহুগুণ শ্রেয়।
হয়তোবা ঘুমাবার আগেই অথবা আধো-ঘুমের ভিতরই শহীদ হয়ে গেলেন। অথবা জেগেই ছিলেন সন্তানকে বুকে নিয়ে; এই বিশ্বাসঘাতক পৃথিবীর কথা ভাবছিলেন। সন্তানদের নিয়ে তাঁদের কি আর স্বপ্ন জাগে? না-ই বা জাগবে কেন? তাঁদের সন্তানেরাই তো আগামী পৃথিবীর রাহবার হবে, যেমন হয়েছিলেন মুসা আ.। কিন্তু...হয়তো স্বপ্ন বুকে রেখে বাঁচতে চাওয়া, বাঁচাতে চাওয়া মানুষটা...অথবা একবুক দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখা নির্লিপ্ত মানুষটা এক রাতে শহীদ হয়ে গেলেন।
আমরা এতটুকুই ভাবি, এভাবেই ভাবি; এতোজন শহীদ হয়ে গেলেন।
একটু যদি চোখ বন্ধ করে অনুভব করি, একটু ভিন্নভাবে। যতটুকু সম্ভব!
সেই মানুষটা আমার মতোই একজন ছিলেন (বা আছেন এখনো, একটু পর হয়তো শাহাদাত বরণ করবেন)। তাঁর জীবনটা আমার মতোই ছিলো। আমার জীবনে যেমন আল্লাহর উপস্থিতি অনুপস্থিতি, আল্লাহর রাসূলের অনুপস্থিতি উপস্থিতি, ইসলামের আদর্শের কম-বেশি ছাপ। তার মাঝেও এমন কিছু ছিল।
মারা গেলেন। কেন মারা গেলেন? 'কীভাবে' নয়। যদি জিজ্ঞাসা করি, 'কেন' মারা গেলেন?
সত্য কথা, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সত্য কথা, আপনার-আমার কাছে তিক্ত সত্য - তিনি মারা গেলেন, কারণ তার জীবনের সময় ফুরিয়ে গিয়েছিল, কারণ তাঁর রিজিক ফুরিয়ে গেছে; শ্বাস নেবার রিজিক, খাবার রিজিক, কথা বলার রিজিক, হায়াতের রিজিক। সব ফুরিয়ে গেছে। তাই বিদায় নিয়েছেন।
কীভাবে বিদায় নিয়েছেন - সেটা ভিন্ন বিষয়। এবং সেটা হয়তোবা অনেকটাই নির্ভর করে মানুষের ইচ্ছা বা নিয়তের উপর; কারো ক্ষেত্রে হয়তো চেষ্টার উপর অথবা অনেক কিছুর উপর...
আমি-আপনি তো ভাবছি ৫০০ জন মারা গেলেন, ১০০০ জন মারা গিয়েছেন; ২০০০ জন মারা গিয়েছেন। কেউ আফসোস করছেন, একজন প্রখ্যাত শিল্পী মারা গেলো! কেউ কাঁদছেন, হয়তো নিজ সন্তানের দিকে তাঁকিয়ে আরো হাজার সন্তানের ছবি চোখে ভাসছে...
তাঁদের ঈমান-আক্বীদা-মাকবুলিয়াত-মৃত্যুর সময়ের অবস্থা কোনকিছুই আমরা জায করার যোগ্যতা রাখি না। ঐ পর্যন্ত আমাদের চিন্তা পৌঁছাবার যোগ্যতা, এমনকি হয়তো অধিকারও নেই।
কিন্তু এবার যদি একটু ভিন্ন দৃশ্যপট থেকে অনুভব করতে যাই - হঠাৎই প্রচন্ড শব্দে মিসাইল আঘাত করলো; সবাই দেখছে আগুনের বিস্ফোরণ, দেখছে বিল্ডিং ধসে পড়া, শুনছে চিৎকার...
যিনি একটু পরেই শহীদের মর্তবা গ্রহণ করবেন - তাঁর কাছে বিষয়টা কেমন থাকে? তিনি কিছুক্ষণ অন্যদের মতোই হয়তোবা সবকিছু দেখেন, শোনেন। তারপর?
তারপর তাঁর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যটা উপস্থিত হয়। জীবনে, এই রূহের জীবনে, যে বিষয়টা আপনার এবং আমার জন্য সমানভাবে সত্য এবং অনস্বীকার্যভাবে সত্য - তিনি মালাকুল মাওতকে দেখতে পান। যখন তাঁকে দেখেন, নিশ্চিতভাবে জীবনের সবকিছু; এই যে আশেপাশের ভেঙে পড়া, চিৎকার, সন্তানের মৃত্যু বা বাবার মৃত্যু সবকিছু বিলীন হয়ে যায়। সবকিছু থেকে তাঁর কাছে গুরত্ববহ হয়ে যায়, তার কাটিয়ে আসা জীবনটা। জীবনের পথটা। তাঁর ঈমান। তাঁর চিন্তা-ধারা।
আমরা বলছি ১০০০ প্রাণ। কিন্তু দুনিয়ার সীমানাটা যখন পাড়ি দিয়ে ফেললেন, তাঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব প্রাণটাই তখন চিন্তার বিষয়। তখন ১ এর হিসাব। একটিমাত্র প্রাণের হিসাব। তখন কি এই ইস্যুগুলো আর তাঁদের কাছে ইস্যু থাকে? থাকা সম্ভব?
যখনই আখেরাতের সীমানায় কেউ পৌঁছে যায়, দুনিয়ার কোন হারজিতই তাঁকে আর ছুঁইতে পারে না।
—
এতো মানুষ ইন শা আল্লাহ শহীদের মর্তবায় পৌঁছে গেলেন, কেউ হয়তো মারা গেলেন। কজনের আর খবর আমরা রাখি?
হয়তো কয়েক যুগ পরে, ধ্বংসস্তুপ থেকে কারো মৃতদেহের অবশিষ্টাংশ বের হবে। সবাই বলাবলি করবে, ২০২৩ সালে ইসরাঈলী হামলার শহীদ...
কিন্তু তিনি তখন? তাঁর কী এসে যায়, এই কয়েক যুগ ধরে কী হল না হলো তাতে? কিছুই না! একদম কিছুই না!
হয়তোবা তাঁর জানাযা হয়নি, নিয়মতান্ত্রিক কবর তো হয়ই নি। তাই বলে কি তাঁর হিসেব-নিকেশ থেমে ছিল; নিশ্চয়ই না! তাঁকেও জবাব দিতে হয়েছে - তাঁর ইলাহ কে ছিল? তাঁর জীবনে আভাস ছিল কার? তাঁর দ্বীন কী ছিল?
তিনি এখন আর আমাদের কাছে কিছু নন, তিনি পাঁচশ বা একহাজার জনের মধ্যে একজন। কিন্তু আখেরাতে? রবের কাছে? আমাদের রব প্রত্যেকের সাথে আলাদা মুয়ামালা করার সক্ষমতা রাখেন। তাঁকে কেউ ফাঁকি দিতে পারে না।
যদি শহীদ না হই - বোমার আঘাতে মরলাম, না ঘরের বিছানায়; তাতে কী আসে যায়? যদি শহীদ হই, কিন্তু ঘাড়ের উপর ঋণের বোঝা রেখে?(১) হয়তো, মৃত্যুর পর সবার কাছে আলোচনার বিষয় হয়ে গেলাম; তাতে কী আসবে যাবে, যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না পারি?
আল্লাহ না করুন, যদি এমন হয়; কবরে কেউ হিন্টস দেবার মতো থাকলো না; আমার জীবনের দিকে তাকিয়ে শুধু একবুক হাহাকার জন্মালো - আল্লাহ না করুন, যদি এমন হয়, তাহলে কীভাবে মারা গেলাম তাতে কী এসে গেলো?
(আল্লাহ করুন, আমাদের ভাইদের বোনদের পূর্ণ শাহাদাতের মর্যাদা দান করুন। তাঁদের অপূর্ণ রাখা যেকোন হক নিজ দায়িত্বে পূর্ণ করে দিন।)
যখন পরিস্থিতি চলে আসে, বরং পরিস্থিতি চলে আসবার আগেই; তার জন্য প্রস্তুতি রাখা - একজন মু'মিনের কর্তব্য, একজন মুসলিমের কর্তব্য, কর্তব্য তাদের সবার - যাদের সামান্যতম সচেতনতা আছে। ভাবনা আছে।
কিন্তু, ব্যক্তিগত উন্নতি, ব্যক্তিগত মাকবুলিয়াত - নিজ নিজ ক্ষেত্রে সবার ঠিক করে ফেলা প্রয়োজন। রিজিক ফুরিয়ে যাবার আগেই। একবার এই দুনিয়ার সীমানা পার হয়ে গেলে, কীভাবে মারা গেলাম - তাতে তেমন কিছু এসে যাবে না! কীভাবে এর বদলে হয়তোবা 'কী করে' মারা গেলাম - সেটাই বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাবে!
(১৮/১০/২০২৩, কিঞ্চিত পরিমার্জিত)
(১) আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত মু’মিনের রূহ্ ঋণের সাথে লটকানো থাকে। - ইবনু মাজাহ ২৪১৩, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ১০৭৮ [হাদিসবিডি]
No comments:
Post a Comment