Tuesday, November 10, 2020

বই কথা বলেঃ কাশগড় - ৩

 ৬.

বয়কট! বয়কট!

আমরা যে আমাদের নবীকে খুউউব ভালোবাসি! তাই সহ্য করতে পারিনি। বয়কট করে দিয়েছি ঐ ফ্রান্সকে, যে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের ভালোবাসার জায়গা, আমাদের নবীকে অপমান করেছে। যতদিন বেঁচে থাকবো, এই কুলাঙ্গার ফ্রান্সের কোনকিছু খাবো না, ব্যবহার করবো না...

সত্যিই! সত্যিই!!

সত্যিই আমাদের ঈমান এতোটাই দৃঢ়?

আমরা কি আমাদের দাবিতে সত্য? সত্যিই সত্য?


ভাই, আমাদের হাবীব বেঁচে থাকলে; কী নিয়ে কাঁদতেন? কী নিয়ে ভাবতেন? তুমি তাঁর চিন্তার জায়গা, তাঁর ভালোবাসার বিষয়, তাঁর ফিকির - কিছুই বুঝলে না, এমনকি বুঝবার চেষ্টাও করলে না; কেমন ভালোবাসা তোমার?

সত্যিই কেমন ভালোবাসলাম তাকে?


তাঁর কল্পিত চিত্রের অপমানে আমরা একতাবদ্ধ হয়ে একটা দেশকে বয়কট করেছি।

যে দেশ তাঁর রবের কালামকে শুধু অপমান নয়, চরম অপমান করেছে, তাঁর সুন্নাহ পালনের জন্য নির্মম থেকে নির্মমতর আচরণ করেছে; যে দেশ তাঁর ভালোবাসার উম্মাতের একটা অংশকে নিঁখুতভাবে নিঃশেষ করে দিচ্ছে; যে দেশ তার অনুসরণকে ব্রেইন ডিফেক্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যে দেশ তার চক্ষুশীতলতার জায়গা নামাযকে নিষিদ্ধ করেছে কেবল তা-ই নয়, চরমভাবে নজরদারি করে লুকিয়ে নামাজ পড়ার স্বাদ থেকেও বঞ্চিত করছে...ভাই, এসব বিবরণ শেষ হবে না...

আমরা পারবো সে দেশকে বয়কট করতে? নাকি 'দুয়া'র অজুহাতে বরাবরের মতো পালিয়ে যাবো?

ফ্রান্সের পণ্যের মতো ঘৃণা করে যদি নিজ ব্যবহার থেকে সব চায়না প্রোডাক্ট বর্জন করতে না পারি; নতুন পণ্য কেনা কি বন্ধ করতে পারবো?

আমরা যদি এক হই, নিশ্চিতভাবে চায়না ধ্বসে পড়বে ইনশাআল্লাহ। পারবো? পারবো?

আমরা আমাদের ঈমানের মজবুতি এখান থেকেই যাচাই করে নিতে পারি। কতটুকু ভালোবাসি আমরা মুহাম্মাদ সা. কে?

আর আজ যদি এড়িয়ে যাই, তার ফলশ্রুতি কতোদিন এড়াতে পারবো? আল্লাহ না করুন, শাস্তি যদি চলে আসে; আমরা তখন আমাদের ভুল স্বীকার করে কী হবে? 

মৃত্যুর আগে শেষ লাথি তো উম্মাহর অনেকেই মারছে। অনেক তো হলো, আর চোখ বন্ধ করে কার উপকার করবো?

আমরা কিচ্ছু করবো না। 

শুধু আমাদের উম্মাহর আগামী প্রজন্মকে একটি সোনালি ভবিষ্যত উপহার দিবো, বোমা-বারুদের ধোঁয়ায় ঢাকা ভবিষ্যত না, মা-বাবা থেকে আলাদা করা ভবিষ্যত না, রক্ত আর রক্তের, দাঙ্গা আর দাঙ্গার ভবিষ্যত না; আমরা উপহার দিবো স্বপ্নের শান্ত ভবিষ্যত, পারবো না?

আমাদের রোহিঙ্গা ভাই-বোনের শুধু নিজের ভূমিটা ফিরিয়ে দেবো, পারবো না? বাড়তি কোন জায়গা দেবো না, কেবল নিজের ভূমি।

আচ্ছা তা-ও অন্যায়? ঠিকআছে, তার ভাই-ভাই হয়ে থাকুক আমাদের সাথে; আমরা শুধু আমাদের আসামের ভাই-বোনদের রক্ত ঝরতে দেবোনা। পারবো না?

আমরা যিনজিয়াং রহস্য উন্মুক্ত করবো, পারবো না?

কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না?

আচ্ছা, আমাদের (ভৌগোলিক) দেশে কোন কালো হাতের ছায়া পড়তে দেবো না। এতটুকুও কি পারবো না?

জাগ্রত উম্মাহ! হে উম্মাহ! এতটুকুও পারবো না? এতটুকুও না? 

কেবল মৃত্যুর আগে ঘৃণা নিয়ে শেষ লাথিটুকু? এ-ও জীবন? 

বই কথা বলে: কাশগড় - ২

৪.

মনে হয়, কতো কিছু লিখবো। এতো কথা একসাথে ভিড় করে, কোনটা লিখা যায় বুঝে উঠতে পারিনা। মনে হয় যেন, স্মৃতি একটু ঘোলাটে হয়ে এলে লেখার কিছু ভাষা ফিরে পাওয়া যায়...কিছুতেই এক বসায় শেষ করতে পারছি না...

চিন্তা-চেতনায় যখন কাশগড়, তখনই হঠাৎ ফ্রান্সের এই খুঁচিয়ে দেওয়া। ওদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট, হয়তো ওরা পরীক্ষা করতে চায়- আমরা কতোটা মুসলমান আছি; অথবা জাস্ট খেপিয়ে দিতে চায়, কোন একটা ইস্যু বের করে আবার নতুন কোথাও হামলা করা জায়েয বানানোর জন্য...

দর্শকের মতো দেখে যাচ্ছি...ফ্রান্সের উষ্কানি; আলহামদুলিল্লাহ মনে একটু জোয়ার আসে, আমরা নিশ্চিহ্ন হইনি ইনশাআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ আমরা আছি, ইনশাআল্লাহ একসাথেই আছি...ভালো লাগে...
ওরা কেন শুধু শুধু খেপাতে চায়? কেন ১৫০০ বছর আগের একজন মানুষকে নিয়ে তাদের এতো 'মাথানষ্ট'? আবার 'শক্ত অবস্থান'? আবার 'পাশে থাকা'? 
আসলে ওরা ভয় পায়...খুব ভয় পায়; আমরা জানিনা, তবে ওরা জানে আমাদের শক্তি কোথায়...এজন্যই ওদের এতো মাথাব্যথা...
কিন্তু...

সব ভালোলাগার মধ্যেও হঠাৎ 'কাশগড়' দপ করে দেখা দিয়ে যায়। হঠাৎ বোবা হয়ে যাই। যা দেখছি, তা কি সত্যি? সত্যিই কি উম্মাহ বেঁচে আছে, জেগে আছে? শুধু আষ্ফালন নয় তো? শুধুমাত্র দুদিন একটু জোর দেখানো না তো? 

এ আন্দোলনকে সপ্রশংসিত উৎসাহ দেখিয়ে তারপর,
প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে - উম্মাহ! আসলেই কি আছো তুমি?
তাহলে বলো - হুযুর সা. যদি বেঁচে থাকতেন, কোন জিনিস নিয়ে বেশি দুঃখিত হতেন? 
আমাদের উম্মাহর পক্ষ থেকে আমাদের জান-প্রাণ দিয়ে হুযুর সা. এর মান-ইজ্জত রক্ষা করা আমাদের ঈমানের দাবী; শুধু দাবী নয়, আরো বেশি কিছু। একে একে প্রাণ দিয়ে দিই, তবু তিনি বেঁচে থাকুন...আমাদের পূর্বপুরুষরা তো এমনই ছিলেন...

কিন্তু বলো দেখি, আমরা যার সম্মানের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত...তাঁর কান্নাজড়িত রাতগুলো দুয়াগুলোর কি আমাদের কাছে কোন মূল্যই নেই?
বলো দেখি, যতদিন বেঁচে ছিলেন - কাদের আদর্শ হবার জন্য তিনি নিজের জীবনকে অতিকষ্টে কাটিয়ে গেছেন? বলো, কাদের জন্য জিহাদ করেছিলেন? কাদের জন্য জীবনের ঝুঁকির সাথে দাওয়াতের কাজ করে গেছেন? তাঁর চিন্তা-ভাবনা জুড়ে কারা ছিলো?
আমরা নই কি? আমাদের ভাই-বোনরা নয় কি? 

আমরা পারবো না, ঠিক পরের মুহুর্ত থেকে তাঁর আদর্শ অনুসরণের দৃঢ় নিয়ত করতে; যার জন্য আমরা প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়েছি?

উম্মাহ! কোথায় ছিলে এতোদিন? তোমার সামনে আমেরিকা একের পর এক তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিলো, যাদের জন্য তোমার নবী নিজের জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করেছেন, যাদেরকে ভালোবেসে গেছেন, জন্মের দেড় হাজার বছর আগেই যাদের স্মরণ করেছেন। 
তোমার সামনেই কাশ্মীর জ্বলছে, তোমার সামনেই ভারতে তোমার ভাইদের জায়গা ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে; তোমার সামনেই তোমার রোহিঙ্গা ভাইয়েরা স্বদেশ ছাড়া হলো..কোথায় ছিলে তুমি?
এখন তোমার চোখের পিছনে_তবে সদিচছুকের সচেতন চোখের পেছনে নয়_তোমার উইঘুর ভাইদের স্রেফ নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে..

আফসোস, ট্যাগ মেরে নবীপ্রেম দাবি করা তুমিই তো আবার দাবি করো..
'ওসব প্রোপাগান্ডা!'
'এসব ওদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার!'
'বাংলাদেশে তো হচ্ছে না! আমরা এখনো স্বাধীন(আলহামদুলিল্লাহ)! ওসব নিয়ে আমাদের চিন্তার প্রয়োজন নেই!'

ছি: কীভাবে এতো জঘন্য হলাম!
ভাবছো, তোমাকেই কেবল বকে যাচ্ছি? আসলে তা নয়, বকছি নিজেকেই..আমি তো তোমারই অংশ..

৫.

তিনটি খবর..

- জাতিসংঘে উইঘুরদের পক্ষে গেলো ২৭টি চিঠি। এর মধ্যে মুসলিম দেশ ছিলো...একটিও না!

- জাতিসংঘে উইঘুরদের বিপক্ষে চায়নার পক্ষে গেলো ৩৭টি চিঠি, যার মধ্যে মুসলিম দেশ ছিলো..গুনো, পারবে না?

https://thediplomat.com/2019/07/which-countries-are-for-or-against-chinas-xinjiang-policies/

- ভারতে গণহত্যার প্রস্তুতি চলছে, জেনোসাইড বিশেষজ্ঞের মতে। এখন আছে ১০টির মধ্যে একদম শেষ ধাপে।
https://www.theweek.in/news/world/2019/12/14/muslims-in-kashmir-assam-1-step-away-from-extermination-genocide-researcher.html


কী মনে হয়? একটুও আঁচ লাগবেনা বাংলাদেশে; যেমন রোহিঙ্গা তাড়ানোর সময়েও লাগেনি, তাই না? বাংলাদেশ তো একদম স্বাধীন, এতো স্বাধীন যে মোদি হুজুর নিজের অধিকারবশেই হুমকি-ধামকি দিতেও খুব ভয় পায়, তাই না?

আরে, চিন্তা করো না ভাই; আমরা উম্মাহবাদী না হলে কী হয়েছে, জাতীয়তাবাদী তো! 
আর ওরা জাতীয়তাবাদী না হলে কি হবে, উম্মাহবিরোধী তো!
একদম চিন্তা করো না; যাও, নিজের কাজে ফিরে যাও।


৬.

আশ্চর্য! কবে আমরা জাতীয়তাবাদের সবক এতো চমৎকারভাবে মুখস্থ করলাম?!
কবে এতো সংকীর্ণ চিন্তাধারার অধিকারী হলাম?

আমাদেরকেই কি অত্যন্ত ভালোবেসে বলা হয়নি-
তোমার একটি দেহ, তোমরা একে অপরের ভাই?

আশ্চর্য! কবে ভুললাম, কেন ভুললাম?
কেন, ওরা তো ভুলেনি!
ওরা আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, ইরাক-সিরিয়ায় কেন বোমা ফেলে? আমরা মুসলিম বলেই তো!
শ্বেতসন্ত্রাসের বলি কারা হচ্ছে? 
কাশ্মীরে কেন রক্তপাত চলছেই? ওরা মুসলিম নয়, এ কারণে?
কেন রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিলো? কেন ভারত রাতারাতি মুসলিমদের ঐতিহাসিক অধিকার কেড়ে নিতে চায়? কেন অসম্ভব গল্প মুসলিমদের নিয়েই ফাঁদে?
কেন চায়নার মনে হয়, তুর্কিস্তানীদেরকেই 'সুশিক্ষা' দেওয়া দরকার?

কেন ওরা সব ভুলে একে অপরের 'পাশে' থেকে যায়? আর আমরাই কেন নিজেরই পাশ থেকে সরে যাই? হ্যাঁ, আমরা তো এক!
ওরা জাতীয়তাবাদের 'সবক' শিখায়, তারপর নিজেরাই তো ভুলে যায়..
ওরা তো মানচিত্রের আঁকিবুকির পরোয়া করেনা! আমরা কেন ওদের এঁকে দেওয়া আঁকিবুকি থেকে নিজের চিন্তাকেও সাজিয়ে নিই?!

কী আফসোস! আফসোস প্রকাশের আলাদা কোন ভাষাও তো নেই!

আল্লাহ কতো করুণাময়, তাঁর অবাধ্য বান্দাদের প্রতিও কতোটা_ভালোবাসা বলবো না? নাকি কেবল ন্যায়বিচার_দেখিয়ে আমাদের সতর্ক করে বললেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَن تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ


মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও (হুজুরাত: ৬)

আর আমরা? 
নিজ সম্প্রদায়ের হালাক হবার, ধ্বংস হয়ে যাবার খবর শুনছি; তবু কেবল পাশ কাটিয়ে চলে যাই, প্রোপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দিই। সত্য না মিথ্যা যাচাই করবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা পোষণ করিনা।
আমাদের বিচার কেমন হওয়া উচিত?
আল্লাহ ক্ষমা করুন। সংশোধনের তৌফিক দিন। 

Saturday, November 07, 2020

স্বপ্নে সহসা

 ইনশাআল্লাহ,

একদিন সব ব্যথা ঠেলে

পৌঁছে যাব ঐ উদ্যানে।

যেখানে সবুজ প্রান্তরে পরম শান্তি মেশে

নীল আকাশের স্বচ্ছতায়।

ত্যাগও কতোটা আনন্দের হয়, তা

প্রিয়র জন্য কষ্ট টেনে নেওয়া ঐ পাখিরাই জানে ।


Monday, November 02, 2020

বই কথা বলে: কাশগড় - ১

আমি লিখতে বসেছি, কারণ আমি জানি আমার লেখা দরকার, কিছু বলা দরকার। হয়তো কী বলতে চাইছি তা প্রকাশ করতে পারবো না, হয়তোবা লেখা পড়ে তুমি সুসাহসী আমার বোকামি দেখে মুচকি মুচকি হাসবে; তবু আমার কিছু বলা দরকার, আমার জন্যই দরকার। তোমার জন্যও..

অচছা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি? তুমি কি আযান শুনে কখনো কেঁদেছ? হাসি আসছে? আচছা, একটু হেসে নাও, এখন তো পরিবেশ শান্ত আছে; কিন্তু আমার একটা অনুরোধ রাখবে? একটু পর যে আযান হবে, মন দিয়ে শুনবে, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত; প্রতিটি শব্দ অনুভব করে..পারবে না?
আচছা, তুমি কখনো অনুভব করেছ; একটু পর পর 'আল্লাহু আকবার' ধ্বনি যে তোমার কানে বেজে ওঠে, তা কতটা সৌভাগ্যের, কতোটা আনন্দের?

আচছা, করোনাভাইরাসের অজুহাতে মসজিদগুলো যখন খালি হয়ে ছিল; আযান হতো, কিন্তু তাতে সাড়া দিয়ে কেউ মসজিদে যেতে পারতো না..তখন কি তোমার কান্না আসতো?
তুমি কি সত্যিই অনুভূতিহীন? আচছা, এক মুআজ্জিন যে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে আযান দিচ্ছিলেন, ওটা কি তুমি শুনছিলে? শাইখ আস-সুদাইস যে শূন্য মাসজিদুল হারামে ইমামতি করতে গিয়ে কাঁদছিলেন, ওটাও শোনা হয়নি? সবটাই কি তোমার কাছে অবিবেচকদের হাস্যকর কাণ্ডকারখানা ছিল?
আসলে কি জানো, ওটা বড় একটা সুযোগ ছিল নিজেকে, নিজের স্বরূপটা বুঝে নেবার..

১.

আচছা আমাকে বলবে, ঠিক কোন ভাষায় তোমাকে বোঝাতে পারবো? কোন ভাষায় বললে তুমি আমার কথাগুলো বুঝতে পারবে? আমাকে বলো, আমি ঠিক সে ভাষায় তোমাকে বলব। ঠিক সে ভাষায় বলবার চেষ্টা করবো, বিশ্বাস করো।

আচছা ভাই, তুমি কি সেই, যাকে পুরুষ বলে, যাকে মানুষ উম্মাহর কান্ডারী মনে করে? তোমাকে নিয়ে একটু কল্পনার জগতে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে চাই। যাবে? শুধু এতটুকু খেয়াল রেখো, তোমার কাছে এখন যা শুধু 'কল্পনা', তা-ই ঠিক তোমার মতো অনেকের কাছে চরম বাস্তবতা। চলো..

আচছা, কেমন লাগবে তোমার? যদি একটা শীতল চোখ তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে তোমাকে খুব সাধারণ একটা প্রস্তাব দেয়, রাজি হও,নয়তো তোমার মাকে নিয়ে যাবো..কোথায়? তোমার জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন নেই, তুমি জানো তারা কোথায় নিয়ে যেতে চায়।

শীতল চোখের আহবান প্রত্যাখ্যান করা তোমার মেরুদণ্ড সহ্য করবে কীভাবে? তুমি রাজি হয়ে গেলে..তারপর, একে একে নিজের বোন, বোনের পরিবার, তার জীবনসঙ্গীর পরিবার, যাকে পারলে..কেউ হয়তো লুকিয়ে ছিলো, তাকে বের করে এনে তুলে দিলে তাদের হাতে, কেউ দেশের বাইরে ছিলো তাকে ডেকে এনে দিলে..শত শত মা, শত শত বোন; নিজ হাতে তাদের ভবিষ্যত্ গড়ে দিলে..

মনে হচছে বেশি বলছি? একটুও না, অনেক অনেক কম বলছি..আমি জানি অনেক কম করে বলছি, তবু বলছি..বলবো বলে, বলতে হবে বলে..

তারপর? যেদিন তোমার মাকে নিয়ে তারা উপস্থিত হতে বলল..সেদিন তোমার মন কী বলছিল? আমি নিশ্চিত, তোমার হৃদয় শূন্য ছিল..আমি বরং আরো যুক্ত করবো- আমাকে বলো, তোমার প্রাপ্য কী ছিল?

ভাই, দুটো অনুরোধ করবো, রাখবে? হয়তো হাসবে এখন, তবু মনে রেখো..

যদি অবস্থা চলে আসে, আল্লাহ না করুন, যদি চলে আসে কখনো আযান বন্ধ হতে দিও না..

একটু চোখ বন্ধ করে ভাবো, একটু নাহয় সময় নাও - সময় নিয়ে বিশ্বাস করে নাও; মুসলিম নামে যত বোন আছে, সবাই তোমার নিজের বোন; যতো মা আছে সবাই তোমার নিজের..

একটা কথা দিতে পারবে? যদি আল্লাহ না করুন, অবস্থা চলে এলে তুমি বেঁচে থাকতে একটা পশুও তোমাকে ডিঙিয়ে তাদের পর্যন্ত পৌঁছতে না পারে..কথা দিয়ে যাও, পারবে না?

https://www.aljazeera.com/features/2019/2/1/exposed-chinas-surveillance-of-muslim-uighurs

......

আচছা আপু, তোমাকে কোথাও ঘুরিয়ে আনবো না। জানো ভাবলে কেমন যেন লাগে, একসময় কিছু 'পুরুষ' ছিলেন; একজন নারীর ক্ষীণ আর্তনাদে তারা, শত শত বরং লাখ লাখ 'তাদের' জীবনবাজি রেখে দাঁড়িয়ে যাবার সাহস ছিল। কিন্তু এখন?

জানো কেমন কষ্ট লাগে, সাহাবীরা যখন হুযুর সা. এর সাথে যুদ্ধে বেরোতেন; রত্নের মতো করেই তারা নারীদের পিছনে সুরক্ষিত রেখে আসতেন। যুদ্ধের কদর্যতা তাদের ছুঁতে পারতো না। এখন যুদ্ধ মানেই...আর ঐ মহাপুরুষদের উত্তরপুরুষরা নিজ হাতে তাদের আত্মসম্মানবোধকে পশুর কাছে বিকিয়ে দিতে খুব বেশি কুন্ঠিত হয় না...

এখন তারা সামান্য দেশীয় হায়েনা থেকেই বাঁচাতে পারে না, আর কি বলার আছে? আর কি ব্যাখ্যা করার আছে?

ওরা হায়েনা নয়, অন্য কোন পশুও নয়; ওরা এমন, যার উপর যেকোন পশু মলত্যাগ করতেও ঘৃণা করবে...জানো, ওরা...

https://www.businessinsider.com/china-uighur-monitor-home-shared-bed-report-2019-11

থাক আর কিছু বলতে রুচিতে কুলাচ্ছে না। আমার সাথে একটা প্রতিজ্ঞা করবে? আল্লাহ না করুন, যদি অবস্থা চলে আসে, আমরা হাতে হাত ধরে শেকল তৈরি করবো। একজনকেও একলা নিতে দেব না; আমরা আলাদা করে কেউ হবো না, সবাই এক অস্তিত্ব হবো। পারবো না?

পারতে হবে না? আপু শোন, তুমি এখন নারী আন্দোলনের অগ্রদূত হতে পারো। কিন্তু জানো, ওরা কিন্তু বিচার করে না কে কতটা নারীবাদী হতে পারলো, কে পোশাকে কতটা উগ্র হতে পারলো, কে ওদের সভ্যতা কতোটা গ্রহণ করতে পারলো। ওরা কী দেখে জানো? ওরা সিসিটিভির ক্যামেরা জুম করে দেখে...তারপর নিয়ে যায়; যাদের নিয়ে যায়, তাদের কেউ ফিরে আসে, কেউ আসে না...

আপু তুমি যদি তাদের একজন হও, যারা এখন 'পশ্চাৎপদ' হতে চায় না বলে বরং আরো কিছু পশু তৈয়ার করছে, নিজ হাতে গড়ছে (ব্যাখ্যা করতে হবে কি?); হয়তো যেদিন প্রয়োজন হবে, তোমার হাত অতটা শক্ত করে ধরতে পারবো না...

২.

বইয়ের পিছনে লেখা 'দূর্বলচিত্তের জন্য নয়' । পড়তে গেলে মনে হয়, বুঝি গল্প পড়ছি, এমন গল্প যেটা লাইন বাই লাইন পড়া কোন সুরুচিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে অসম্ভবের মতো।

তবু আমার পক্ষে যদি সম্ভব হতো, প্রতিটি লাইন প্রতিটি মুসলমানকে পড়াতাম। হয়তো তুমি হার্টের রোগী, হয়তো রাতে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে যাবে, হয়তো খাবারের রুচি চলে যাবে, হয়তো বমি আসবে - তাতে কী?

আমাদেরই কেউ কেউ এক অজানা গোপন এক দুনিয়ায় বসে প্রাণপণে হয়তো চাইছে, আমি প্রায় নিশ্চিত তারা চাইছে, পুরোটা দুঃস্বপ্ন হোক। রুচির কথা বাদ দাও, এসব সস্তা রুচিবোধের গল্প করে কী হবে? তারা তো খাবারই পায় না; দিনে একবারের বেশি হাত ধোয়ার তাদের অধিকার নেই, কারাগারের কক্ষের এক কোনায় রাখা একটা বালতি ছাড়া আলাদা একটা বাথরুমের অধিকার নেই; সেই বালতিতেও দিনে দুমিনিটের বেশি অধিকার নেই...

একটু হলেও সচেতন হবে কি? আমরা মুসলমানরা তো এমনই, চোখে ঠুলি পরে আছি। আতঙ্ক, ঘৃণা দিয়ে যদি সচেতনতা আসে, তাহলে খারাপ কি?

......

আমরা ভুলে যাই, আমরা মুসলিম। ওরা ভোলেনা।

আমরা জানি না, আর আমাদের জানবার আগ্রহও নেই, আমাদের কাছে কী সম্পদ আছে; তবে ওরা জানে, খুব ভালোভাবে জানে।

আমরা ভুলে যাই, আমরা উম্মাহ, এক উম্মাহ। ওরা ভুলে না, ওরা কাদের নিকেশ করতে চায়।
আমরা দু'একটা স্যাড রিএক্ট করে, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, 'দুআ ছাড়া কিছু করার নেই' বলে দায়িত্বমুক্তির ভান ধরি। আর ওরা? প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধ্বংস করে, শেকড় উপড়ে দিয়েও জেনে রাখে 'কাজ বাকি আছে'।

যাদের কাছে পথ স্পষ্ট হয়ে গেছে, তবু যারা ভুলে থাকতে চায়, নিজেদেরকে ধোঁকায় ফেলে রাখতে ভালোবাসে; যাদের নেই আত্মমর্যাদাবোধ; যাদেরকে বুঝিয়ে প্রমাণ দেখিয়ে কোনভাবেই জাগানো যায় না; বিনা চাওয়ায় পাওয়া ইসলামরূপী রত্নের যারা কদর করতে জানেনা এবং চায়ও না; মাশুল যদি তারা না দেয়, তবে মাশুলের কোটা কার জন্য রাখা?

৩.

চেয়েছিলাম কিছু ভিডিও শেয়ার করে দিই, এতো 'নারীসমৃদ্ধ' আর 'মিউজিকসম্পন্ন' ভিডিওগুলো শেষ পর্যন্ত আর শেয়ার দিলাম না। কেউ চাইলেই বের করে নিতে পারে, যদি ইচ্ছে থাকে। যার ইচ্ছে নেই, কী বলার আছে?
কেমন যেন খারাপ লেগে উঠে। যারা দেখে শুনে বুঝে এসেছে, আমরা তো ওদের মতো করে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ওরা কেউ কেউ সেসব অবস্থা পার হয়ে এসেছে, নিজের চোখে দেখে এসেছে...এসেও বুঝতে পারছে না(আমরাও পারছি না, জানিনা পারবো কিনা), কেন ওদের(আসলে আমাদের, আমাদের পুরো উম্মাহর) কেন এ পরিণতি, কেন এ অবস্থা?

আমরা অন্ধের মতোই...থেকেই যাই, থেকেই যাই...
ওদেরই অনুসরণ করতে চাই, নিজেকে জলাঞ্জলি দিতেই থাকি...মূর্খতার সাগরে...
ওদেরই অনুসরণ করতে থাকি...যারা দিনশেষে কড়ায় গন্ডায় ওদের অনুকরণের দাম শোধ করে যায়...

Wednesday, September 23, 2020

হঠাৎ দিনলিপি ১

একফাঁকে হঠাৎ দুটো একটা জীবন গল্প শোনা হয়ে যায়। কেন হয়? ঐ যে, নিজেকে নিজে থেকে বাঁচাতে। আল্লাহকে বন্ধু বানানোটা কেন যে হলো না এখনো।

শুনলাম, আর ভাবলাম - হায়রে! আমিও তো ঠিক এমনই এক বোকা। পার্থক্য হলো, আমি বুঝে বুঝে অনেকখানি স্বেচ্ছায় বোকামি করেছি বা করছি, আর কেউ করে একেবারে অন্ধবিশ্বাসে; যেটা করিনি সেটা হলো মনে হয় যেন আল্লাহ বাঁচিয়েছেন আর হয়তোবা কিছুটা মান-সম্মান বাঁচাবার খাতিরে। তারপরও, নাহ..আচ্ছা থাক কী হবে নিজেকে অ্যানালাইসিস করে।

আর একটা কথা, জানিনা কেন কথাটা এতো সত্য - কেউ যখন কারো প্রতি আগ্রহ দেখায় আর বিপরীতপক্ষ জিরো একটিভিটি দেখায় তখন সেই কেউ সবকিছু উজাড় করে সামান্য রেসপন্স পেতে চায়। কথাটা কিবরিয়া ভাই থেকে ধার করা। কিন্তু অসম্ভবভাবে সত্য..আবার যদি নিজেকে বিরত রাখা হয়, একটু দৃঢ়তা দেখানো হয় সেই বিপরীতপক্ষ হয়তোবা অনেকসময় আবার ঠিক একরকম আগ্রহ দেখায়। কিন্তু কেন?

কী হতো সহজভাবে কেউ কারো আগ্রহের মূল্য দিলে?..জানিনা, কিন্তু আল্লাহর সাথেই ব্যাপারটা ভিন্ন..সামান্য এগিয়ে যাও আল্লাহর অসামান্যভাবে এগিয়ে আসবেন..হেঁটে যাও আল্লাহ দৌড়ে আসবেন..তোমার আগ্রহ তুচ্ছ করলে আল্লাহর কিছু হারাবার ভয় নেই, তোমার আগ্রহে সাড়া দিলে তাঁর নিজের রাজত্বে কিছু বৃদ্ধি হবেনা..তিনিই সর্বোচ্চ অহংকারের অধিকারী..তবু যদি ডাকো, যদি একটু আগ্রহ করো; সাড়া দিবেন অভাবনীয়ভাবে..

তবু মানুষ তাকেই ভুলে যায়, আর আশা করে অহংকারী মাটির তৈরি পদার্থ থেকে, খুব জলদি যারা অনুগ্রহ ভুলে যায়..

তবে আল্লাহর 'বান্দা'রা কি আর একটু অন্যরকম হবে না? হবে না কেন?..চলোনা সবাই, তাঁরই বান্দা হই, বান্দী হই..

Sunday, August 02, 2020

এ অশ্রু কিসের?

বহুদিনের একটা প্রশ্ন ছিল মনে, মানুষ ইসলাম গ্রহণের সময় কাঁদে কেন। কেমন যেন স্বতঃস্ফূর্ত একটা কান্না কাঁদতে থাকে, শুধু সুখ-আনন্দের কান্না নয়; কেমন একটা আবেগের কান্না..ঠিক যেন বোঝা যায় না..

এই ভিডিওটা দেখে(পড়ুন 'শুনে') কিছুটা কি বুঝতে পারলাম?
 

আসলে ঈমানের একটা ভার আছে, অনেক ভার..আল্লাহ তা'আলা দয়া করে ঈমানী পরিবেশে, ঈমানী পরিবারে জন্ম দিয়েছেন..আমরা হয়তোবা তাই সেই ভার একটু একটু করে বহন করে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাই সহসা উপলব্ধি করি না, করতে পারিনা..কিন্তু যাদের শূন্য, একেবারেই শূন্য হৃদয়ে কালিমার আলোকছটা হঠাৎ করে এসে পড়ে - তাদের হয়তোবা বুঝে আসে; ঈমানের সেই পূর্ণতার ভার হঠাৎ করে তাদের হৃদয় হয়তোবা সইতে পারে না, তাই হয়তোবা কাঁদতে থাকে..তাই হয়তোবা জড়িয়ে ধরবার মত একটা অবলম্বন লাগে..তাই হয়তোবা..

(অবশ্য আমরাও হঠাৎ কখনো এই ভার টের পাই, তাই না? কখনো আমাদের ঈমান বাড়ে, কখনো আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা বাড়ে, তাঁর উপস্থিতির অনুভূতি বাড়ে..তখন আমরাও হঠাৎ হঠাৎ কাঁদতে থাকি..

ইশশ্, যদি আমরা বুঝতাম কতো বড়, কতো মহামূল্যবান সম্পদের না চাইতেই অধিকারী হয়ে আছি..)

ইচ্ছে করে নিজ চোখে এই অনুভূতিগুলোর স্বাক্ষী হতে..

ঐ আয়াতগুলোর মনে পড়ে, (জানিনা যদিও এর সাথে সম্পর্ক আছে কিনা..) -

إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَن يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنسَانُ ۖ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا  سورة الأحزاب ٧٢ -

অর্থ: আমি আকাশ পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে এই আমানত পেশ করেছিলাম, অতঃপর তারা একে বহন করতে অস্বীকার করল এবং এতে ভীত হল; কিন্তু মানুষ তা বহণ করল। নিশ্চয় সে জালেম-অজ্ঞ।

 لَوْ أَنزَلْنَا هَـٰذَا الْقُرْآنَ عَلَىٰ جَبَلٍ لَّرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنْ خَشْيَةِ اللَّـهِ ۚ وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ ﴿٢١


অর্থ: যদি আমি এই কোরআন পাহাড়ের উপর অবতীর্ণ করতাম, তবে তুমি দেখতে যে, পাহাড় বিনীত হয়ে আল্লাহ তা’আলার ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে গেছে। আমি এসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্যে বর্ণনা করি, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।



Tuesday, April 21, 2020

ফিরে আসা প্রশান্তিতে

নিজের উপর বিরক্ত লাগছে নিশির। কিছুতেই আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারছে না। একবার ভালো করে বুঝাচ্ছে নিজেকেই , দেখো নিশি, এটা একটা মাখলুক। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া এটা কিছুই করতে পারবে না তোমার । তোমার কাছেই ঘেষতে পারবে না..

কিন্তু কাজ হচ্ছে না কেন যেন। ঈমানী কথাগুলো মাথায় ঠিক ক্রিয়া করছে না। অস্থির অস্থির লাগছে, শরীরে-মনে। শেষমেষ একটা ধমকই লাগালো নিজেকে , কি হলো তোমার! এভাবে অস্থির অস্থির করে কী লাভ হচ্ছে! এভাবে কি মৃত্যু ঠেকাতে পারবে? প্রস্তুতিটাও তো নিতে পারবে না..

নাহ..মৃত্যুভয় নয়, নিজেকে বলে নিশি। মৃত্যু, কবর, হাশর - কোনকিছুই তার মাথায় খেলা করছে না। তাছাড়া স্ট্যাটিসটিক্সও দেখেছে। তুলনামূলকভাবে মৃত্যুহার তো কমই..কিন্তু কেমন অদ্ভুত আতঙ্কগ্রস্ত লাগছে। যেন বাড়ির বাইরে মিলিটারি এসে দাঁড়িয়ে আছে, যে কোন মুহূর্তে ঢুকে সব তছনছ করে দেবে।

ভাগ্যিস OCD(১) নেই নিশির , থাকলেও কেবল অর্ধেকটা আছে। পুরোটা থাকলে আর দেখতে হতো না..তার মনে হচ্ছে, সবকিছুর মধ্যে করোনা কিলবিল করছে, জামা-কাপড়, বিছানা, ল্যাপটপ থেকে বইপত্র সবকিছুতে। কোনমতে ঠেকিয়ে রেখেছে নিজেকে..আর কীই বা করবে! এখন বুঝি রুম শাওয়ার করা শুরু করবে? কভি নেহি ম্যান..

*

হইচই শুনে বই থেকে মুখ তুলে তাকালো নিশি। একটা ছেলে পড়ে গেছে বোধহয় কাদায় পিচ্ছিল খেয়ে। তাই এতো আনন্দ । একটু অন্য ভাবনায় ডুবে গেল । এই তো ছেলেগুলো কী সুন্দর হাসছে, খেলছে! কে বলবে ওদের মধ্যে কারো করোনা নেই ? শুধু ছেলেরা? ঐ তো একপাশে খেলছে মেয়েরাও। এতক্ষণ কানামাছি খেলছিল, এখন অন্য খেলার প্ল্যান চলছে বোধহয়। ঐ যে ফ্রক করা মেয়েটা , এক ফাঁকে জামায় নাক মুছে নিলো। আর ছেলেগুলোও..ঘামছে দরদর করে , কেউ শার্টের হাতায় , কেউ বা রুমালে-গামছায় মুখ মুছছে।

একটা শ্বাস ফেলে আবার বইয়ে চোখ ফেরালো নিশি। আতঙ্ক কাটাতে শেষমেষ বইয়েরই আশ্রয় নিয়েছিলো সে। তারপর আছর হতেই উঠে এসেছে ছাদে। ইদানিং বই কেনাই হচ্ছিল না..মামীমার কাছে টাকাটা হাদিয়া পেয়ে ভাবলো , আচ্ছা এবার কিছু বইই কিনি! কী ভাগ্য ! হাতে এসে মাত্র পৌঁছল প্যাকেটটা , তার দুদিন পরেই কার্ফু শুরু! কী যে সৌভাগ্য - বইগুলোর দিকে চোখ পড়লেই মনে মনে শুকরিয়া করে নিশি।

কিন্তু বইয়ে মন টিকছে না এখন, চোখ উঠিয়ে আবার রাস্তার দিকে তাকাল। সব স্বাভাবিক, কোন আতঙ্ক নেই কোথাও; নেই শংকা , ভয় , সচেতনতা তো বহুদূর!

মনে মনে হাসলো নিশি। এখনই যদি কেউ মাঠটা এক চক্কর ঘুরে গলির এমাথা-ওমাথা একবার টহল দিয়ে কাশতে কাশতে ঘোষণা দেয় যে , আমি করোনা। ব্যস , পুরো এলাকা নিশ্চিত ফাঁকা হয়ে যাবে। আসলে কিছু কিছু মানুষের সচেতনতা মনে হয় সম্ভাবনার আপেক্ষিকতার ভিত্তিতে কাজ করে । আর সম্ভাবনা নির্ধারিত হয় কী দিয়ে? হয়তো প্রত্যক্ষ জ্ঞান দিয়ে । হয়তোবা এ কারণেই করোনার বিস্তার সূত্রের জ্ঞান তাদের ক্ষেত্রে কাজ করে না । তবে একজন কাশির রোগীকে নির্দ্বিধায় একঘরে করে দেয়। আবার সন্দেহযুক্ত কেউ মারা গেলে তাকে এলাকায় দাফন করতেই ভয়! আচ্ছা, করোনায় মারা গেলে কি লাশ থেকে ভুরভুর করে করোনা বের হয়?

এক স্তরের মানুষকে লজিক বুঝানো যায় না; কেউ বুঝেও বুঝতে চায় না, কারো তাওয়াক্কুল আ’লাল্লহ এখন লজিকের আওতায় নেই। শত বুঝালেও তাঁদের মস্তিষ্ক করোনা ট্রান্সমিশনের মতো ব্যাপার উপলব্ধি করতে পারে না । আচ্ছা, আল্লাহ তাদের সাথে কীভাবে মুআমালা করবেন? তাদের তাওয়াক্কুলকে গ্রহণ করে তাঁর প্রতি তাদের ধারণা অনুযায়ী ব্যবহার করবেন , নাকি তাদেরকে করোনা ছড়াবার উসিলা হিসেবে নির্ধারণ করবেন?

বই বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকালো নিশি। মনটা আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসছে। পরীক্ষার আগের রাতে যদি কেউ আবিষ্কার করে তেমন কিছুই পড়া হয়নি অথবা মৃত্যুর সময় নির্দিষ্ট করে দিলে , যেমনটা কেউ কেউ শান্ত হয়ে প্রস্তুতি নেয়..মনে মনে বললো - 'আল্লাহ! তুমি কতো পবিত্র! আমরা তো তোমাকে ছেড়ে আসবাব নিয়ে থাকতে ভালোবাসি, আসবাব নির্ভর হতে চাই! তুমি দেখিয়ে দিচ্ছো , আমরা আসবাব গ্রহণেও কতোটা অপারগ! ' - চোখ ভিজে গেলো নিশির - 'আল্লাহ, যেভাবে ভালোবেসে আমাদের তুমিমুখী করে নিচ্ছো, তৌফিক দাও সেভাবেই ভালোবেসে যাতে তোমাকে অন্তরে অনুভব করে নিই..আজীবন..'

*

মুগ্ধ হয়ে সাবান মাখা হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে নিশি। নাহ , মুগ্ধতা হাতের সৌন্দর্যের কারণে না; তার মাথায় একটু আগে শিখা যে দুআটা ঘুরছে তার কারণে । ভাবছে , কে এতো সুন্দর এতো উপযুক্ত দুআটা চালু করেছেন! কী করে তিনি জানতেন যে, হাত ধোয়ার সাথে এ ধরনের একটা দুআর প্রয়োজন হবে!(২)..

ট্যাপ ছেড়ে দিলো নিশি-

(৩)اللهم اني اسالك اليمن و البركة و أعوذ بك من الشؤم و الهلكة

নিশির মন অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠছিল। ইশ! কতোদিন ধরে মন দিয়ে উযূটাও করা হয় না। এতক্ষণে মনে পড়লো , উযুর সাথে তো সমস্ত গুনাহও ধুয়ে চলে যায়। যত্ন করে বাকি উযু শেষ করলো নিশি। পা ধোয়ার সাথে সাথে খেয়াল হলো - আরে! উযুর পানি না শেফা! ধ্যাত ! বিরক্ত হলো নিশি নিজের উপরই, মগে উযু করার অভ্যাসটা এখনই করে ফেলতে হবে। আর 'পরে কখনো'র জন্য ফেলে রাখা যাবে না ।

মাগরিবের নামাযের পর সন্ধ্যার দুআগুলো নিয়ে বসলো নিশি । একইসাথে মুগ্ধতা, তৃপ্তি আর প্রশান্তি খেলা করছিল তার মনে। ধীরে ধীরে অর্থ মিলিয়ে মিলিয়ে উচ্চারণ করছিল সে -

(৪)حَسْبِيَ اللَّهُ لا إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ

(৫)بِسْمِ اللَّهِ الذي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَىْءٌ في الأَرْضِ وَلاَ في السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

(৬)أَعُوذُ بِكلِمَاتِ الله التّامّاتِ مِن شَرّ مَا خَلَقَ

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فِي دِينِي وَدُنْيَاىَ وَأَهْلِي وَمَالِي اللَّهُمَّ اسْتُرْ عَوْرَاتِي وَآمِنْ رَوْعَاتِي وَاحْفَظْنِي مِنْ بَيْنِ  يَدَىَّ وَمِنْ خَلْفِي وَعَنْ يَمِينِي وَعَنْ شِمَالِي وَمِنْ فَوْقِي وَأَعُوذُ بِكَ أَنْ أُغْتَالَ مِنْ تَحْتِي




মন ভরে যাচ্ছিলো নিশির..

اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ

*

রাতে শুতে যাবার আগে ভালোবাসা নিয়ে একবার বইয়ের স্তুপের একেবারে উপরে তাকায় সে। নাহ! ধূলিমলিন নয় কিতাবটা, দুদিনে একবার হলেও তো হাতে নেয় সে তাকে..

শুয়ে পড়লো নিশি। সকালের আগেই উঠে পড়তে হবে , তার সাথে গল্প করবে না?

হুম, মৃত্যুকে সে ভয় পায় না। কেউ যদি তাকে হাতে ধরে, পদে পদে তাঁর ভালোবাসাকে স্মরণ করিয়ে দেয় , তারঁ ডাকে সাড়া দিতে ভয় কি তার? কিন্তু, তাঁর চিঠিটা বুকে নিয়ে যেতে না পারলে বড় আফসোস থাকবে..

……..তথ্যসূত্রঃ…...

১.Obsessive-Compulsive Disorder (OCD)। শুচিবায়ু।

২.উযূর অঙ্গগুলো ধোয়া/মাসেহ করার দুআগুলো হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবে বুযুর্গানে দ্বীন এগুলো পাঠ করেছেন বা করেন।(আহকামে যিন্দেগী)

৩.অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট মঙ্গল ও বরকত কামনা করি এবং অমঙ্গল ও ধ্বংস থেকে পানাহ চাই।(আহকামে যিন্দেগী)

৪.অর্থঃ আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। আমি তারই উপর নির্ভর করি। তিনি মহা আরশের অধিপতি। (সুরা তওবা: আয়াত-১২৯)

৫.অর্থঃ আল্লাহর নামে, যার নাম (স্মরণের) সাথে আসমান ও যমীনে কোন কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। আর তিনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী।(আবু দাউদঃ ৫০৮৮)

৬.অর্থ: আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমাসমূহের উসিলায় আমি তাঁর নিকট তাঁর সৃষ্টির ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাই। (মুসলিমঃ ২৭০৯)

৭অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি আমার দ্বীনদারি ও দুনিয়ার, আমার পরিবার ও সম্পদের। হে আল্লাহ! আপনি আমার গোপন ত্রুটিসমূহ ঢেকে রাখুন, আমার উদ্বিগ্নতাকে নিরাপত্তায় পরিণত করে দিন। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে হিফাযত করুন আমার সামনের দিক থেকে, আমার পিছনের দিক থেকে, আমার ডান দিক থেকে, আমার বাম দিক থেকে এবং আমার উপরের দিক থেকে। আর আপনার মহত্ত্বের উসীলায় আশ্রয় চাই আমি নিচ থেকে হঠাৎ ধ্বংস হওয়া থেকে।(আবু দাউদঃ ৫০৭৪)

৮সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার। (বুখারী ৬৩০৬)