Monday, October 17, 2022

বিবাহবিভীষিকা ও আমরা

 'বিয়ে কঠিন' - প্রসঙ্গে যে আলোচনাগুলো উঠে আসে তার প্রায় সবটা জুড়ে থাকে বিভিন্ন ধরনের বিদআত, কনেপক্ষের বড় অংকের মোহরের দাবি, বরপক্ষের যৌতুক অথবা কন্যার রূপের দাবি, বাবা-মা এর বিভিন্ন কারণে অমত ইত্যাদি। স্বয়ং বিবাহকেই কীভাবে কঠিন হিসেবে অবিবাহিতা মেয়ের কাছে প্রতীয়মান থাকে সেটা সযত্নে বা অযত্নে অবহেলায় আলোচনা থেকে একরকম উহ্যই রাখা হয়। 
এ কাঠিন্যের ফল হচ্ছে অভিভাবক ও কন্যা দুপক্ষেরই উত্তম সময়ে বিবাহ থেকে নিবৃত্ত রাখা ও থাকা, তারপর সামগ্রিকভাবে কন্যার বিবাহ-পূর্ব বা পরবর্তী জীবনে এমন সমস্যায় পড়া যা কন্যার কোনভাবেই প্রাপ্য ছিল না। অথচ সঠিক সময়ে না সে বুঝতে পারে, না বুঝতে পারে তার অভিভাবক। অবশেষে যখন অনেক কিছু বোঝার সময় হয়ে যায়, তখন আর পিছিয়ে এসে পুনরাবৃত্তির সুযোগ থাকে না; শুধু আফসোস করাটুকু বাকি থাকে। 

- পড়াশোনা করে না তো, বিয়ের পর জামাইয়ের বাড়ি হাঁড়ি ঠেলবে গিয়ে। (বিয়ে করলে জামাইয়ের বাড়ি হাঁড়ি ঠেলাই হচ্ছে কাজ)
- রান্না শিখো না যে! শ্বশুরবাড়ী গিয়ে রান্না করে খাওয়াতে হবে না? (শ্বশুরবাড়ী গেলে রান্না করে খাওয়ানোটা অন্যতম কাজ, এজন্য বিয়ের আগেই রান্না শেখা দরকার)
- জামাই কি বসায় বসায় খাওয়াবে? (জামাইরা বসিয়ে খাওয়ায় না, কাজের বিনিময়ে খাওয়ায়)

আমরা (এ ধরনের কন্যারা) বড় হই বিয়ে সম্পর্কে এ ধরনের বিভিন্ন বিরূপ মন্তব্য শুনে শুনে। আমাদের পানিশমেন্ট থাকে - বিয়ে। যার সাথে পড়াশোনার সম্পর্ক হচ্ছে দুই পৃথিবী দূরত্ব প্রায়। কেউ এতোটা পানিশমেন্ট না দিলেও এসব উল্লেখ করতে ভুলে না -

- স্বামীকে মান্য করা ফরজ। অমান্য করা যায় না। (স্বামীর সাথে মূল সম্পর্কটাই হচ্ছে অর্ডার এন্ড ওবেই। মন না চাইলেও কষ্ট করে মানতেই হবে)
- সংসার বড় কঠিন পরীক্ষার জায়গা। 
- বিয়ে তো ছেলেখেলা না। অনেক দায়িত্বের বিষয়। 

আমরা বড় হতে হতে মন-মগজে এ কথাটাই খুব ভালোভাবে গেঁথে যায় যে, বিয়ে এমন একটা জিনিস যার সাথে কঠিন সংসার কঠিনভাবে জড়িত। সংসার কঠিন এক কারাগার, যাতে বিয়ে নামের এক বেড়ী পায়ে পরে ঢুকতে হয়। আর ঐ বেড়ীর অপরপ্রান্ত ধরা থাকে 'স্বামী'র হাতে, যে যখন যা ইচ্ছে অর্ডার করতে পারে, যেটা আমাদের ইচ্ছে না থাকলেও মানতে হবে। যদি না মানতে চাই, থাকবে আল্লাহর লানত। আর যেহেতু শ্বশুরবাড়ির খেদমত করলে স্বামী সন্তুষ্ট থাকবে, এ কারণে বিয়ের সাথে সাথে শ্বশুরবাড়ীর সাথে এডজাস্টমেন্ট এবং রান্না-বান্নাসহ বিভিন্ন কাজের জন্য আফটার অল প্রস্তুত হয়ে যেতে হবে। 

কথাগুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে যতোই সঠিক থাকুক, বাবা-মায়ের আদরে বড় হওয়া, দ্বীনের চর্চা থেকে একটু দূরে থাকা(ইভন দ্বীনের চর্চাযুক্ত ফ্যামিলিগুলোতেও দাম্পত্যের সৌন্দর্যের অংশটুকু সযত্নে আলোচনা থেকে উপেক্ষিত হয়), জীবনে-কিছু-একটা করতে চাওয়া কন্যার কানে সেগুলোকে মোটেই সঠিক এবং গ্রহণযোগ্য মনে হয়না। তার মনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, 'ইসলাম এতো কঠিন কেন?'। সাথে সাথে দাম্পত্য-কলহের সুর, স্বামীর আধিপত্যের সুর প্রতিনিয়ত তার কানে বেজেই যায়। বিয়েটাকে সে কোন অংশেই গ্রহণযোগ্য, অন্তত তার বর্তমান তারুণ্যের সুন্দর সময়ে গ্রহণযোগ্য কিছু বলে মনে করতে পারে না। 

সে মোটামুটি দৃঢ় শপথ নিয়ে নেয় যে, নিজের ভবিষ্যতটুকু সে কোনভাবেই এতো অনাকাঙ্খিতভাবে কাটাবে না। বলা বাহুল্য, এই কন্যাদের অভিভাবকেরাও গ্রহণযোগ্য দাম্পত্য জীবনের সৌন্দর্য হয়তো খুব কমই দেখেছেন। তাই ভালোবাসা বশতঃই তারা কন্যার কানে সহজে বিয়ের কথা তোলেন না। তারা আমাদের সত্যিই ভালোবাসেন, তাই ইসলামপ্রদত্ত কন্যার অনুমতির অংশটুকু তারা ইগনোর করেন না, আমরা না চাইলে তারা চাপিয়ে বিয়ে বসিয়ে দেন না। 'একদিন তো স্বামীর বাড়ি যেতেই হবে, তখন তো চাইলেও অনেক কিছু করতে পারবে না', বিয়ে একেবারে দিবেন না এমনও তো ভাবতে পারেন না, তাই কয়েকটা বছর কন্যাকে কিছুটা নিজের মত করে কাটাতে দেন (হয়তো নিজের চাপা দেওয়া শখ-আহ্লাদের কথা মনে পড়ে যায়)। বিলাসী না হোক, নাজায়েজ না হোক, তাদের জায়েয শখ-আহ্লাদগুলো অপূর্ণ রাখেন না। 

বাবা-মার স্নেহ-আদরে থাকা আমরা স্বভাবতঃই একটা মোটামুটি আনন্দময় জীবন কাটাই। তাই বিয়ে আমাদের কাছে বিভীষিকারই একটা পর্যায়। যেখানে বাবা আমার পছন্দের জিনিসগুলো বাছাই করে আনেন, আমার কষ্ট হবে বলে মা অনেক কাজ থেকেই অব্যাহতি দেন, একটু আবদার করলে চা বানিয়ে দেন, আমাকে হাসতে দেখে খুশি হন; সে জীবন থেকে কষ্টকর বিবাহিত জীবনে পদার্পন করার কোন মানেই থাকে না আমাদের কাছে।

কেমিস্ট্রি-বায়োলজি পড়া, টুকটাক শখের কাজগুলো গুছিয়ে নেওয়া, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবার শখ মনে রেখে সোৎসাহে পড়াশোনা করে যাওয়া আমাদের কানে হঠাৎ যখন বাজে 'মেয়েদের জীবনে স্বামী-সংসারই আসল, সন্তান লালন-পালন করাই তাদের মূল দায়িত্ব' - আমরা আরেকটু বিতৃষ্ণ হয়ে উঠি। পড়ায় আরেকটু মন দিই, নিজ প্রতিজ্ঞায় আরেকটু দৃঢ় হই। 

এত ক্লান্তিকর সংসারে পদার্পণ করা থেকে ফোনে বেজে ওঠা টুং এর জবাবে ছোট করে আরেকটা টাং আমাদের কাছে ঢের সহজ। কেউ যখন বলে - 'এটা ফেতনার সময়, বিয়ে করে নাও। পবিত্র থাকবে, ভালো থাকবে।' - আমরা বক্তার পজিশন অনুসারে হয়তো ইগনোর থাকি, অথবা মুচকি হেসে এড়িয়ে যাই অথবা বিরক্তি প্রকাশ করি।

আমাদের বর্তমান জীবনে তো আল্লাহ অসন্তুষ্ট নন। আল্লাহ আমাদের কিছু আগ্রহ দিয়েছেন, আমরা সেই আগ্রহের চর্চা করি। বাবা-মায়েরা আমাদের উপর তো অসন্তুষ্ট নন, আমাদের ছোট সংসারে আমরা হাসিখুশি থাকি টুকটাক বাবা-মায়ের সাহায্য করি; আর আমাদের লক্ষ্যপূরণে এগিয়ে যাই। এর থেকে সুন্দর জীবন আর কি হতে পারে? এ জীবন ছেড়ে 'বিয়ে' নামের শৃঙ্খল পায়ে পরে, স্বামী নামক আতঙ্ক গ্রহণ করে বাচ্চাধারণ করে পালার আইডিয়া আমাদের কাছে স্রেফ পাগলেরই প্রলাপ।

বিয়ে কি এবং কেন - এসব আমাদের জানার কোন প্রয়োজনই নেই। ঈমানের কম-বেশ অনুসারে, কখনো আমরা টুকটাক সম্পর্ক মেইনটেইন করি, কখনো আমাদের আভিজাত্যের বশে এসব থেকে দূরেই থাকি। তবে অন্তরের গহীন থেকে জানি, এখন না হোক পাঁচ-দশ বছর পর 'বিয়ে' নামক বিভীষিকা আমাদের গ্রহণ করতে হবে, তার জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিতে হবে। 

এভাবে গেঁথে দেওয়া বিরূপ মনোভাবের প্রভাব কি আমাদের দাম্পত্য জীবনে পড়বে না? 

Saturday, October 01, 2022

অভিভাবক ও আমাদের বিবাহ

 আমাদের জেনারেশনের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অভিভাবকরা বিয়ে নিয়ে কয়েক ধরনের জুলুম করে। দ্বীনের জ্ঞান নেই, তারা তো একরকম। আর দ্বীনিবোধ রাখা অভিভাবকেরা দ্বীনের নামে কয়েক ধরনের জুলুম করেন। 

প্রথমত, বিয়েকে তারা কঠিন, অনাকাঙ্খিত, যত-দেরিতে-হয়-ভাল এমন একটা বিষয় হিসেবে রাখেন। অনেকটা নিষিদ্ধ প্রথার মত। 
দ্বিতীয়ত, সন্তানের ১৬-১৭ বয়স থেকে যে অনুভূতিগুলো তৈরি হতে থাকে, সেগুলোকে একরকম ইগনোর করেন। 
তৃতীয়ত, এ অনুভূতিগুলোকে প্রপারলি হ্যান্ডেল করেন না।
চতুর্থত, অবশেষে সন্তান যখন নিজ থেকে অনুভূতি প্রকাশের জায়গা খুঁজে নেয়, তারা পিছনের কারণ রেখে নিজের মান-সম্মান, সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন ইত্যাদি নিয়ে হায়-আফসোস করতে থাকেন।
পঞ্চমত, এমন সময় বিয়ের এরেঞ্জমেন্ট করেন, যখন দাম্পত্য জীবনে যে অনুভূতিগুলো সম্পর্কটাকে দৃঢ় করতে পারত সেগুলো একরকম হারিয়ে অধিকারবোধ প্রবল হয়েছে।
ষষ্ঠত, বিয়ের আগে দাম্পত্য জীবন, সংসার ইত্যাদি নিয়ে, এমনিভাবে বাচ্চা পালন ইত্যাদি নিয়েও কোন ধরনের শিক্ষাপ্রদানের ব্যবস্থা করেন না।
সপ্তমত, বিয়ের আগে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ব্যবস্থা করেন না, 'সবর' 'বিয়ে তো একটা পরীক্ষা' ইত্যাদির আড়ালে সব ঔচিত্য হারিয়ে যায়।
অষ্টমত, বিয়ের পর কোন সমস্যা হলে কেউ 'সবর' ও 'পরীক্ষা'র সবক দেন; কেউ বদনামে নেমে পড়েন। ভুলে যান যে, এ দাম্পত্য বিষয়ক সমাধানের জন্য হুযুর সা. এর আদালতে জায়গা ছিল, যেখানে প্রপারলি বিচার করা হত। শুধু 'সবর' এর সবক পড়ানো হত না।
আর যারা ডিভোর্সকে সমাধান ভেবে আদাজল খেয়ে লাগেন, তাদের কথা বাদ ই থাক। 
নবমত, দাম্পত্য জীবনের এই গ্যাঁড়াকল দেখে  বাকিরা যখন বলতে থাকে - 'আমার বিয়ের ইচ্ছা নেই', 'আমি ত্রিশ বছরের পর বিয়ে করব', 'পড়াশোনা শেষ করে নেই' ইত্যাদি, তখন তারা চুপ থেকে সহমত জানান। 

অভিভাবককে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া যেহেতু একেবারেই বেহায়াপনা; অতএব চুপ থেকে অনেকেই ত্রিশের কোঠা পার করে ফেলেন, 'তাকদীর' বলে সবকিছু মেনে নেন। আর ভিতরে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তা প্রকাশ করা তো নিষিদ্ধ এবং লজ্জাজনক তাই প্রকাশ করেন না, এভাবে সবচেয়ে সুন্দর সময়টাকে একেবারে হারিয়ে ফেলেন। 

----

শুরু এবং তারপর

শুরুটা সুন্দরই থাকে। একজন সন্তান একটা সুস্থ সুন্দর শিক্ষিত পরিবারে গড়ে উঠতে থাকে। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের কালচারে বেহায়াপনা নেই, তাই ম্যারিটাল বিষয় বা অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে যদি কিছু কথা চালাচালি হয়, সেটা বড়দের সামনে হয় না, সমবয়সীদের মাঝে হয়। কিন্তু বড়দের সামনে হয়না মানে তার অস্তিত্ব নেই এমন নয়। একটা পরিবার যতো শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত হোক না কেন, একটা সমাজের রীতিনীতি যেমনই হোক,  এজন্য আল্লাহর নিয়ম থেমে থাকবেন না। তিনি যে নিয়মে মানুষকে ম্যাচুউরিটি দেন, সেভাবেই এখনো দিবেন। তাই একটা মেয়ের(ছেলেদের কথা আপাতত থাকুক, তাদের সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই) ১৬-১৭ বছর থেকেই কিছু অনুভূতির সৃষ্টি হতে থাকে। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক, এটা অভিভাবকেরাও জানেন। সবাই জানে। 

সমস্যা হচ্ছে, যখন অভিভাবকেরা সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ইগনোর করে যান। ব্যাপারটা এমন না যে, তারা বিয়ে দিয়ে দিবেন। তারা সম্পূর্ণ ব্যাপারটা সুন্দরভাবে হ্যান্ডেল করবেন, এটাই কাম্য। কিন্তু তারা করেন না, করেন না যে তার প্রমাণ হচ্ছে পরবর্তীতে হঠাৎ করে তারা কিছু অনাকাঙ্খিত সংবাদ পান। কী সংবাদ পান, সেটা কি সরাসরি বলতে হবে?

এই ঘটনাগুলো যদি শুধুমাত্র এক পরিবারে, এক যুগে একবার হঠাৎ ঘটতো তাহলে এটাকে এক্সেপশন ধরে নেওয়া যেত। রিপিটেডলি কোন ঘটনা ঘটলে তাকে আর এক্সেপশন বলা যায় না, তার সমাধানের জন্য ফিক্সড কোন উপায় খুঁজতে হয়। 

দ্বীনি ফ্যামিলিগুলোতে থেকেই আমরা সিনেমা-নাটক দেখার স্পেস পাই। সেগুলোতে কী কনটেন্ট থাকে অভিভাবকরা তা জেনেও না জানার ভান করেন। 'বিয়ে করব' বলা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ, কিন্তু হারাম কনটেন্ট দেখা, হারাম কনটেন্ট পড়া আমাদের জন্য নিষিদ্ধ নেই। আমরা যত্রতত্র যখন তখন চোখের পবিত্রতা হারাই, অন্তরের পবিত্রতা হারাই। এগুলো চোখে দেখা যায় না, তাই এগুলো আমাদের জন্য পারমিটেড; গোপনে রিলেশনে জড়িয়ে আবার ফিরে আসতে পারি, এটাও পারমিটেড (কোন কোন দ্বীনদার-বলে-পরিচিতদের মধ্যে তো প্রকাশ্য রিলেশন ই পারমিটেড)। কিন্তু হালাল সম্পর্কে জড়িয়ে জীবনটাকে পবিত্র করা, গতিশীল করতে চাওয়া আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। 

---

উপার্জনক্ষমতা

যে আল্লাহ পারস্পরিক অনুভূতির সৃষ্টি করেন, সে আল্লাহ কি এতটাই জুলুমকারী যে (একজন ছেলের ক্ষেত্রে) এভাবে অন্তত ৯-১০ বছর টেনে নেওয়ার পর (চাকরি পাবার পর)বিবাহের পারমিশন দিবেন? এতটাই কঠোর যে, অনুভূতিগুলো তৈরিও করবেন, আবার তিনি যেসব কাজ করতে অনুমতি দেননি সেসব করলে গোনাহও দিবেন (সাথে সাথে অভিভাবকদেরও দায়ী হিসেবে গোনাহ দিবেন এবং এই অবস্থায় ঐ সন্তানের মৃত্যু হলে তাকে অপরাধী হিসেবে শাস্তি দিবেন), আবার একই সাথে(২৫-২৬ বছর পর্যন্ত চাকরি পাবার আগ পর্যন্ত) বিবাহের অনপযুক্ত করে রাখবেন? 

কখনোই না। হতেই পারে না।
একটা ছেলে অবশ্যই অন্তত ২০-২২ বছরে (বাইরের দেশে তো আরো কমেই হয়) উপার্জনের সক্ষমতা রাখে। এটা সম্পূর্ণ অভিভাবকের জুলুম যে, তাকে ধীরে ধীরে অনেক বছর সময় লাগিয়ে প্রায় ৩০ এর কাছাকাছি পৌঁছার পর উপার্জনে সক্ষম করার প্রসেস চালানো হয়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা যেমন হোক - পরিবর্তন যদি দ্বীনদারদের পক্ষ থেকে না হয় কোত্থেকে হবে? তারপর একজন দ্বীনদার ছেলে উপার্জন ছাড়া বিয়ে করতে চায় না, এটা তার পক্ষ থেকে ঠিক থাকুক অভিভাবকের পক্ষ থেকে এটা কেমন ন্যায় হলো? 
আল্লাহ কুরআনে সরাসরি বলেছেন - 

وَ اَنۡکِحُوا الۡاَیَامٰی مِنۡکُمۡ وَ الصّٰلِحِیۡنَ مِنۡ عِبَادِکُمۡ وَ اِمَآئِکُمۡ ؕ اِنۡ یَّکُوۡنُوۡا فُقَرَآءَ یُغۡنِهِمُ اللّٰهُ مِنۡ فَضۡلِهٖ ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ
[আর তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিয়ে সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও। তারা অভাবগ্ৰস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন; আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।]

আয়াতের তাফসীরে যাবার যোগ্যতা নেই। তবে কেউ চাইলে ভেবে দেখতে পারে, আল্লাহ কেন সরাসরি এ ওয়াদা করছেন? এটাই যদি উত্তম সিস্টেম হতো যে, একজন ছেলে প্রায় ২৭-২৮ এ পৌঁছে উপার্জনক্ষম হয়ে (স্বাভাবিক ডিফারেন্স রাখলে ২৩-২৪ বছরের কাউকে) বিয়ে করবে, তাহলে এই ওয়াদার কী প্রয়োজন ছিল? 

হাদীস তো প্রচুউউর। এগুলো এখানে উল্লেখ করলে অনেকেই ধৈর্যহীন হয়ে যাবেন। 

-----
পড়াশোনা

একটা কমন কথা হচ্ছে, বিয়ে দিলে পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাই...
এখানে আর কী বলব? সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এমন জীবন কীভাবে কাম্য হয় যেখানে পড়াশোনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে রাখা হয়? যতো বয়স ই হোক না কেন, এটা কীভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব যে পড়াশোনাকে জীবনে খাটো করে দেখা হবে? অথচ, জীবন গড়ে ওঠার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের পড়াশোনা অবশ্যই চালু রাখা দরকার। এবং শিক্ষার কোন শেষ নেই। বিশেষ করে, দ্বীনদার ফ্যামিলি থেকে কীভাবে এ ধরনের কথা উঠতে পারে? 

যদি পড়াশোনা এমন হয়, যেটার ফলাফল, কল্যাণ অনেক ব্যাপক অন্তত সে ধরনের পড়াশোনাকে থামিয়ে রাখার তো মানেই নেই। [হ্যাঁ, কেউ যদি মনে করে আপাত-বৈরাগ্যের জীবনে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে নিজেকে জাতির জন্য প্রস্তুত করবে, সেটা ভিন্ন কথা; কিন্তু সেটা স্বাভাবিক উদাহরণ হতে পারে না]

এছাড়া আরেকটা কথা হচ্ছে, অনেকেই গবেষণামূলক পড়াশোনা, উচ্চতর জটিল পড়াশোনা করেন বিয়ের পর এমনকি সন্তানাদি হবার পর। তখন কীভাবে তা সম্ভব হয়?

-----
একটা শিক্ষিত পরিবারের পক্ষ থেকেই আশা করা যায় যে, তারা একটা নতুন জীবন শুরুর করার আগে ঐ নতুন জীবন সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা দিবেন যেন সন্তান নতুন পরিবেশে নতুন সম্পর্কগুলোকে সহজভাবে মেইনটেইন করতে শিখবে। এই শিক্ষা শুধু মাসআলাগত শিক্ষা না, ঠেকে শেখার শিক্ষা না, বরং সিস্টেমিক শিক্ষা যেন ঐ সন্তানের পরবর্তী জীবন নিয়ে ভীতি না থাকে। যেন এটা তার কাছে অন্ধকারে ঝাঁপ দেবার মত না হয়। 

তাহলে সম্পর্কগুলো কমপ্লিকেটেড হয় না, টেনশনের হয় না; সুস্থ-সুন্দর হয়। শুধু শিক্ষার কল্যাণে অনেক জটিল অবস্থা সৃষ্টিই হবে না, সমাধানের পর্যায় যাওয়া তো দূরে থাক। 

একটা বড় ব্যাপার হলো, এমন পরিবেশে দেবার নিয়ত করা এমন ভার চাপানোর নিয়ত করা যা সন্তানের ক্যাপাসিটির বাইরে। যেমন, এখন সে ৭-৮ ঘন্টা পড়াশোনা করে; এমন জায়গায় দেওয়া যে ৭-৮ ঘন্টা রান্নাঘরেই থাকতে হবে। তাহলে এই বিয়ে কারই বা চাহিদা হবে, না অভিভাবকের, না সন্তানের। 

আমার পর্যবেক্ষণ থেকে (পর্যবেক্ষণে সম্পূর্ণ নির্ভুল দাবি করছি না) , বিবাহভীতির বেশিরভাগ পয়েন্ট তৈরি হয় এমন কিছু বিষয় থেকে যেগুলোর নির্দেশনা ইসলামে নেই। বেদ্বীন যারা প্রথা মেনে চলে তাদের কথা বাদ, দ্বীনদাররা দ্বীনের বাইরের এমন বিষয়গুলোর নাম 'দ্বীন' 'ইসলাম' দিয়ে বিয়েটাকে কঠিন বানিয়ে তারপর বিয়েকে আপাত-নিষিদ্ধ করে দেন। এ সার্কেল থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে অনেকের জন্যই সহজ হতো। 

যাই হোক, মোদ্দাকথা হচ্ছে, বিয়ে যদি অনাকাঙ্খিত বিষয় হয় তবে সারাজীবনই এ থেকে দূরে থাকা হোক, দূরে রাখা হোক।
আর যদি এতে কল্যাণ আছে বলে মনে করা হয়, তবে এমন সময়ই এরেঞ্জ করা হোক, যখন কল্যাণ সর্বোচ্চ হবে, উপকারিতা সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে। যে সময়ে মানুষের স্রষ্টা, সম্পর্কের স্রষ্টা, আমাদের অভিভাবক আল্লাহ তা'আলা এবং পৃথিবীর সবচেয়ে স্বচ্ছ ব্যালেন্সড বুঝদার মানুষ হুযুর সা. সাজেস্ট করেছেন [অবশ্যই তৈরি করে]। আমাদের জেনারেশনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টাকে নষ্ট, অপবিত্র করার পথে দেয়াল তুলে দেওয়া হোক। কিছু সুন্দর সুন্দর কাম্য দৃষ্টান্ত তৈরি হোক। 

Friday, August 19, 2022

জীবনে জুড়ে জড়িয়ে থাকুক অনেক কৃতজ্ঞতা

একটা বাবু ঘুমিয়ে আছে। দেখে কেমন যেন মায়া জেগে ওঠে। নিজের অজান্তেই কিছু আদরসূচক শব্দ করে ফেলি। বাবুটা ঘুমিয়ে আছে, শুনতে পাচ্ছে না কিন্তু তারপরও আদর জেগে ওঠে। এখন তো সে ঘুমিয়েই আছে, আদর দিয়ে তো তার দরকার নেই, তবু আদর করতে ইচ্ছে করে।

আচ্ছা এই যে অনুভূতিটা, বাচ্চাদের প্রতি যে প্রত্যেকটা মানুষের একটা কেয়ারিং এর ফিলিংস, একটা মায়া, আদর-ভালোবাসা - আসলে এগুলো তো আল্লাহ প্রদত্ত। একটা বাচ্চা ঘুমিয়ে থাকলেও, তার বাহ্যিক প্রয়োজন না থাকলেও এই যে আদরের ইচ্ছেটা - এগুলো তো আল্লাহ দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কেন দিলেন? 
কারণ চটজলদিই মাথায় চলে আসে - কারণ একটা ছোট বাচ্চার এগুলোর খুব প্রয়োজন।  একটা বাচ্চার আসলে শুধু মা না, তার আশেপাশের সবার থেকে এটেনশন দরকার, কেয়ারিং দরকার - তাই আল্লাহ এগুলো তার আশেপাশের সবার অন্তরে দিয়ে দেন। যেমন পৃথিবীতে আসার সাথে সাথে তার প্রয়োজনীয় খাবার দিয়ে দেন; বেশি গরম, বেশি ঠান্ডা না, একদম প্রয়োজনীয় তাপমাত্রার খাবার দেন, কারণ ওটাই তার দরকার। তেমনি, সব বাচ্চার প্রতি সব মানুষের ভালোবাসার অনুভূতিগুলো দিয়ে দেন, কারণ তাদের জীবনের এই অংশটাতে এগুলোর খুব দরকার তার।

একটা নতুন জীবন শুরু করার জন্য এই স্নেহ-মায়ার বন্ধনগুলো, এই আদরের হাতগুলোর কত প্রয়োজন! একটা বাচ্চা তাহলে আদরের সাথে জীবনের এই পার্টটা ধীরে ধীরে পার করে, স্নেহের হাত ধরে হাঁটতে শিখে, চারপাশে হাসি মুখ দেখে বড় হয়, স্বাভাবিকভাবে তার নিশ্চয়ই বোধ হয় পৃথিবীটা অনেক আনন্দের একটা জায়গা (যদিও পৃথিবীটা চিনে না তখনও)। সে জীবনটাকে নিশ্চয়ই ভালোবাসতে শিখে। 
সে জানে যে আমি পড়ে যেতে নিলেও কেউ ধরে ফেলবে, পড়তে দেবে না। ব্যথা পেলেও সে বুঝে যায় যে, আমার ব্যথা দূর করার মত অনেকেই আছে। কান্না করে ঘুম থেকে উঠলেও সে কাউকে দেখতে পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। সে ভয় পেলেও কোন না কোন হাত এসে স্বান্তনা দেয়। সে মানুষকে দেখে খুশি হয়, হাসে। সে নিশ্চয়ই অনেক আত্মবিশ্বাসী হয়।  
অস্বাভাবিক কত কিছুই তো হয়। কিন্তু ছোট বাচ্চারা, যারা তখনো ভাষা বুঝেনি,ওদের জন্য এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? সে এই মায়াগুলো এই কেয়ারিংগুলো ডিজার্ভ করে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় পায়ও। 

আল্লাহ তো প্রত্যেক জিনিসের ভিতর একটা নমুনা রেখেছেন। বাচ্চাদের জীবনের এই পার্টটা দেখে কি আমরা বুঝতে পারি যে, প্রতিটা নতুন জীবনের জন্য স্নেহের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, কেয়ারিং করা, পাশে থাকাটা কতটা জরুরী? 

আমরা জীবনের এক একটা অংশে এসে অনেকেই ভাবি, আমাকে কেউ বুঝতে চায় না, আমার পাশে কেউ থাকে না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু উলটো করে কি ভাবি? অর্থাৎ যারা জীবনের নতুন পার্টগুলো শুরু করছে, তাদের প্রতি কি আমাদের এই চিন্তাটা আসে যে, তার প্রতি হেল্পফুল থাকা, তার এই জীবনের ছোট ছোট সমস্যাগুলোর কেয়ার করা কতটা জরুরী?
একটা বাচ্চা ছোট একটা আঘাত পায়, কাঁদে, আমরা সাথে সাথে আদর করে কোলে তুলে নিই, ব্যথার জায়গাতে তাড়াতাড়ি আদর করে ব্যথা কমাবার চেষ্টা করি। কিন্তু কেন? এমন তো না যে, তাকে আদর না করলে ব্যথা কমতো না। ব্যথা কমে যেত, কিন্তু বাচ্চারা জন্য এটা বোঝা খুব জরুরী যে, তাকে কেউ এতটা অবহেলা করছে না।

জীবনের এক একটা অংশকে আমরা এক একটা নতুন জীবন বলে প্রায়ই বর্ণনা করি। যেমন, কৈশোর জীবন, স্কুলজীবন, কলেজজীবন, বিবাহিত-জীবন, চাকরি-জীবন ইত্যাদি। আসলে জীবনের প্রতিটা অংশই তো 'নতুন করে' কিছু একটা শুরু করা, তাই না? আর এই প্রত্যেকটা জীবনেই কিন্তু এই কেয়ারিংটা প্রয়োজন। 
আমরা হয়তো মনে করি, সে ম্যাচিউরড, তার এটা বুঝে নেওয়া উচিত ইত্যাদি। কিন্তু এখানে ঔচিত্যের প্রশ্ন না, সে 'নতুন' - এভাবে কি চিন্তা করা কঠিন? তার এই নতুন জীবনে ঠিক ঐভাবেই কিছু স্নেহের হাত, কিছু সাহচর্য, কিছু হাসিমুখ দরকার আত্মবিশ্বাসের জন্য; যেভাবে তার ছোটবেলায় তার দরকার ছিল। তারপর সে যখন একটু পথ এগিয়ে যাবে, দাঁড়াতে শিখবে, হাঁটতে শিখবে, ব্যালেন্স করা শিখবে; আস্তে আস্তে তার হাত ছেড়ে দেওয়া যায়, বাকি পথটুকু যেন নিজে এগিয়ে যেতে পারে। 

হ্যাঁ, কেউ ঠেকে শিখে। অনাদরে, অবহেলায় কি বাচ্চারা বড় হয় না? তাদের অনেকেই তো এই অবহেলা থেকে আস্তে আস্তে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যেতে শিখে। এসটাবলিশড হয়। কিন্তু এটা কি কাম্য?আমরা কেন আল্লাহর নিজের দেওয়া নমুনা ছেড়ে, এই ঠেকে শেখার ফর্মুলা প্রয়োগ করবো? পৃথিবীটা কি আরেকটু সুন্দর হতে পারে না? আরেকটু স্নেহশীল, আরেকটু কেয়ারিং হতে পারে না? 

Wednesday, June 29, 2022

#রৌদ্রময়ী_ফিলহাল_প্রকাশন_প্রতিযোগিতা_২০২২_ইং প্রযুক্তির ব্যবহার - অপব্যবহার

দেয়াল 

 ১

ভাপা পিঠা তৈরি করেছেন মা। এই শীতের প্রথম পিঠা। মৌসুমের প্রথম পিঠার স্বাদ তো অবশ্যই প্রতিবেশীদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে হয়! তো সেই সুবাদেই জারিনের অনেক দিন পর যাওয়া মৃদুলদের বাসায়।

আন্টির হাতে হাদিয়া দিয়ে টুকটাক কথা বলছিল জারিন। হঠাৎ ভেসে আসে একটা বাচ্চা কন্ঠ। খুব আদুরে গলায় বলছে - জানু! তুমি আর রাগ করে থেকো না। তুমি রাগ করে থাকলে আমি রাতে ভাত খাবো না! ...এই তো লক্ষ্মী জান! উম্মা...উম্মা...

অবাক হয়ে কন্ঠের সোর্স খুঁজল জারিন। পাঁচ বছরের মৃদুল সোফায় উপুড় হয়ে আছে; হাতে তার মায়ের ফোনটা, সেখান থেকেই ভেসে আসছে কথাগুলো। বিস্মিত হয়ে মৃদুলের কাছে গেল জারিন, ইউটিউবের কোন চ্যানেলের আপলোড করা ভিডিওই হবে। ভিডিওতে যে ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে তার বয়স টেনেটুনেও আট বছরের বেশি বলা যাবে না। যে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে তার বয়সও এমনই ৬-৭ বছর হবে।
পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, বোকা বাবা-মাদের অযত্নে ফেলে রাখা ছেলে-মেয়েদের টোপ বানিয়ে ব্যবসা করার জন্য এসব ভিডিও তৈরি করেছে। পাবলিকের অনুভূতি মজা পাবে যাতে, সেটাই তাদের টোপ হবে। আর বাকি অন্যান্য বিষয় - কচিমনগুলোর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করার ফুরসত বা দরকার কোনটাই এই ব্যবসায়ীদের নেই।

জিজ্ঞাসু চোখে মৃদুলের মায়ের দিকে তাকাল জারিন। তেমন অপ্রস্তুত মনে হলো না তাকে। একটু প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বললেন, এগুলো কী ভিডিও যে ইদানিং তৈরি করেছে! বাচ্চাগুলা কি পাকনা পাকনা কথা বলে। মজাই লাগে দেখতে!

জাহিন কী বলবে বুঝতে পারলো না। তবু কিছু বলার চেষ্টা করল, বলেও বুঝল এগুলো মৃদুলের মায়ের সেন্সের বাইরে দিয়ে চলে গেছে...

...

কয়েক মাস পর। জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল জারিন। নিচের দিকে চোখ পড়তেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। মৃদুলদের বাসাটা একতলা, সংলগ্ন উঠান আছে; উঠানের আরেক পাশে মৃদুলের জ্যাঠার পরিবার থাকে। উঠানটাতে সেদিন দৃশ্যপটে ছিল মৃদুল আর তার কয়েক মাস ছোট বয়সের চাচাতো বোন। যে দৃশ্য সে দেখল, তা প্রকাশ করার ভাষা জারিনের নেই। এ শুধু ইংলিশ সিনেমাতেই অহরহ দেখা যায়। 

তারপর থেকে জারিন তাদেরকে দেখে মাঝেমধ্যে ভাবে। তাদের হয়তো ঐ 'বুঝ' নেই। কিন্তু মেয়েটাকে দেখেই বোঝা যায়, কয়েক বছর পর ফুলের মত ফুটবে; আরো কয়েকবছর পর আগুন-সুন্দরী হবে। ছেলেটাকে দেখলেও বোঝা যায়, ধীরে ধীরে 'পুরুষের মত পুরুষ' হবে। তারপর কী হবে?
তাদের বাবা-মায়ের দ্বীনের সম্পূর্ণ বুঝ নেই। তাদের মধ্যে এখন পর্দা নেই, ছেলে-মেয়ে দুটো বড় হতে হতে পর্দার বুঝ কি আসবে? 
যদি না আসে, এরা ঠিক এভাবেই বড় হতে থাকে; তারপর কী হতে পারে, সেটা ভাবতে গেলে জারিনের চিন্তাশক্তি স্থবির হয়ে আসে। সবচেয়ে ট্রাজেডিক ব্যাপার, এদের যদি সুবুদ্ধি থাকে, বড় হওয়ার পর সবকিছু বুঝে এবং স্থায়ী সম্পর্ক গড়তে চায় এস্টাবলিশমেন্টের আগেই - দুটো পরিবার থেকেই বাধা দেওয়া হবে। কী অদ্ভূত এই সমাজ! 

ঘরের একপাশে একত্র হয়ে আড্ডা দিচ্ছিল সবাই। হঠাৎ ঘরের আরেক কোণ থেকে ভেসে আসে ৮ বছরের মিথিলার চিৎকার - এই তোমরা চুপ করো, চুপ করো। মিথিলার আওয়াজে সবাই বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকাল। মিথিলা কম্পিউটারে দেখছিল কিছু একটা, এটেনশন সিক করার জন্য অহেতুক চিৎকার করছে।

কম্পিউটারের দিকে তাকাতেই তার এটেনশন সিকিং এর কারণ বোঝা হয়ে গেল সবার। নাহ, ফিল্মটা বাজে কিছু ছিল না; বাচ্চাদের উপযোগী এডভেঞ্চারাস একটা ফিল্মই ছিল। কিন্তু ইংলিশ ফিল্ম বলে কথা, হ্যাপি এন্ডিংটা যেন একটা কিসিং সিন ছাড়া জমেই না! এই সিনটাই মিথিলার এটেনশন সিক করার প্রেক্ষাপট।
কিন্তু তার ঠিক এই সময়ে এটেনশন চাওয়ার কারণ কি? কারণ হচ্ছে এটা যে একটা স্পেশাল সিন, এটা বোঝার মত বয়স বা নলেজ তারও হয়েছে।

মিথিলার পরিবার অশিক্ষিত ভ্রষ্ট না; বরং মোটামুটি রক্ষণশীল পরিবার। স্বভাবতই মিথিলার মা অপ্রস্তুত হয়ে তার দিকে তেড়ে গিয়ে বকাঝকা করলেন। তাতে কী, কম্পিউটার তো মিথিলা নিজে আনেনি, এই ফিল্মও নিজে আমদানি করেনি। সবাই জানে, এই ফিল্ম সে অসংখ্যবার দেখেছে এবং আরো অসংখ্যবার দেখবে। 

ফুপুর বাসায় এবার বেড়াতে যাবার পর একদিন শারীনাকে চুপিচুপি এক পাশে ডেকে নিল অর্ণব। বাসায় এমনিতেও তেমন কেউ ছিল না, কয়েকটা পিচ্চি-বাচ্চা ছাড়া। শারীনাকে পিসির রুমে নিয়ে দরজা আটকে দিল।

এগারো বছরের শারীনার বুক ধকধক করছিল। তাহলে কি এতদিনের আকাঙ্খা পূর্ণ হতে যাচ্ছে? চার বছর ধরে অর্ণবের প্রতি পুষে রাখা অনুভূতি কি আজ একটা আশ্রয় পাবে? হ্যাঁ, অবাক করা হলেও সত্যি, সাত বছর থেকেই সে পাশাপাশি বড় হয়ে ওঠা অর্ণবের প্রতি গভীর অনুভূতি লালন করছে। তাই আজকের মুহুর্তটা অবশ্যই তার কাছে বহু আকাঙ্খিত!

তাকে পিসির কাছে টেনে নিয়ে গেল তের বছরের অর্ণব। তারপর এমন দৃশ্য দেখালো যার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না শারীনা। তারপরও এগুলো তেমন ক্রিয়া করল না তার উপর। তার অস্তিত্ব-মন তো অন্য কিছু তে ডুবে রয়েছে।

অর্ণবের আগ্রহে পানি ঢালবে না বলে পিসিতে চলতে থাকা ফিল্ম নিয়ে টুকটাক প্রশ্ন করল তাকে শারীনা। এটা কি? ওটা কি? এটা এমন কেন হচ্ছে ইত্যাদি। অর্ণব আগ্রহ নিয়ে উত্তর দিল, কিন্তু সব উত্তরই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল শারীনার। সে শুধু সুযোগ পেয়ে মন ভরে তার প্রিয়কে দেখছিল, আর চোখের ভাষায় কিছু বুঝাবার চেষ্টা করছিল।

...
তারপর হয়ে গেছে অনেক বছর। শারীনা এখন অনেক বড় হয়েছে। সে দিনটার কথা হঠাৎ কোনদিন মনে পড়লে সে মনে মনে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। সেদিন এর থেকে বেশি কিছু হয়নি। যদি হতো, কিছু স্মৃতি নিশ্চিত তাকে প্রেতাত্মার মত তাড়া করে বেড়াত। 
তার চোখের ভাষা বুঝেছিল কিনা অর্ণব তা জানে না শারীনা। কিন্তু এতদিনে একটা কষ্টকর বাস্তবতা তাকে স্বীকার করে নিতে হয়েছে, ছেলেরা মনের অনুভূতির সংজ্ঞা থেকে অন্যকিছুর সংজ্ঞা দ্রুত বুঝে এবং বেশি বুঝে। 

প্রেতাত্মার মত করে যদি কাউকে কিছু তাড়া করে, তাহলে তার ভিকটিম সাথী। মাঝেমধ্যে কি করবে বুঝে না সে, মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে মন চায়। কেন এ ভুলটা করল, তা নিয়ে আজও নিজেকে বকাবাদ্য করে সে। বকাবাদ্য করে লাভ কি, মানুষের মন-মগজ-অনুভূতি কি মানুষের কথা মতো চলে?

দোষটা আসলে পুরোপুরি তারও ছিল না। এই তো গত বছরেরই কথা, ক্লাস এইটে তখন সে। এক খালার বাসায় গিয়েছে, আপি ভার্সিটিতে পড়ে। বেড়াতে গেলেই অনেক আনন্দ-ফুর্তি হয়, মজা হয় আপির সাথে। সেই আপিই একদিন একটা কার্টুনের নাম বলে তাকে জিজ্ঞাসা করল, এটা দেখেছিস? অনেক এডভেঞ্চারিং, দেখ মজা পাবি!

বাসায় থাকলে তো পড়াশোনার জন্য বাবা-মা তাকে তেমন কোনকিছুরই ফুরসত দেয় না। সময় নষ্ট হবে বলে মোবাইল তো দূর কি বাত, পিসিও দেয় না। সুযোগ পেয়ে তাই মজা করেই দেখছিল সাথী। এন্ডিং সিনটায় গিয়ে হয়ে গেল সমস্যা। সিনটা সেই যে মাথায় গেঁথে গেছে, আর তাড়াতে পারে না। সময়ে-অসময়ে যেন তাকে তাড়া করে বেড়ায়, বিরক্ত লাগে সাথীর। কিন্তু কী করবে বুঝে না।

শেষে বান্ধবী তৃণাকে একদিন বলেই ফেলল - দোস্ত, তোরও কি এমন হয়? 
তৃণা শুনে বুঝতে পারছিল না, কী সমাধান দিবে। একটু ভয় দেখিয়ে গেলো সাথীকে - তোর এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা দরকার! কোন জিনিস কোথায় গিয়ে ঠেকে, কেউ বলতে পারে না!

ব্যস, এই বলে তৃণা তো খালাস। কিন্তু সাথীর হয়ে গেল বড় সমস্যা...

____

উপরের প্রতিটি ঘটনা জীবন থেকে নেওয়া, আমার নিজের জানা/শোনা/দেখা। হয়তো একটু প্রেক্ষাপট, চরিত্র পালটে দিয়েছি, কিন্তু মূল গল্পগুলো অবিকৃত। 

সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে - এ ধরনের গল্পগুলো (এবং এর থেকে ভয়ানক গল্পও আছে) তৈরি হচ্ছে 'দ্বীনদার' বলে পরিচিত মানুষের ঘরে। যাদের দ্বীনের জ্ঞান নেই, তাদের কাছ থেকে এখনই খুব বেশি কিছু আশা করা কঠিন, তাদের ব্যাপারে আশা করা যায়, একদিন হিদায়াতের আলো যখন তাদের অন্তরকে আলোকিত করে দেবে, ইনশাআল্লাহ তাদের ছোট ছোট অবহেলাগুলো আর থাকবে না।
কিন্তু যখন 'দ্বীনদার'দের ঘরে এ ধরনের ঘটনা তৈরি হয়, তখন সেগুলো কতটা আশাপ্রদ হয়? তাঁরা হয়তো 'দ্বীনদার', কিন্তু তাঁদের সন্তানদের যেভাবে প্রশ্রয় দিয়ে, যে মানসিকতা দিয়ে বড় করে তুলছেন, ঘৃণ্য বিষয়গুলো যেভাবে তাদের কাছে সহজ করে দিচ্ছেন, এমনকি পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে তাদের জন্য দ্বীনকেই কঠিন করে দিচ্ছেন, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম কী করে এই দ্বীনের পতাকাবাহী হবে? 

আমাদের প্রজন্ম এবং আমাদের অভিভাবকের প্রজন্মে রয়ে গেছে বড় ফাঁক। তাঁদেরকে তাঁদের বাবা-মা হয়তো খুব যত্ন করে বড় করেছিলেন; অনেকেই একটু রক্ষণশীল বা অভিজাত পরিবার থেকে গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের শিক্ষা। জীবনের আনাচে-কানাচে থাকা অনেক কলুষ থেকে তাঁদের পৃথিবী ছিল পবিত্র। 

কিন্তু এই পৃথিবী তার যত মন্দ, যত কলুষতা, অপবিত্রতা হঠাৎ করে প্রকাশ করে দিয়েছে, যার অন্যতম মাধ্যম হয়েছে ইন্টারনেট। হঠাৎ খুব দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে, হঠাৎ অনেক ফেতনা একসাথে প্রকাশিত হয়েছে; যেসব বিষয় তারা নিজেরা তাঁদের বাল্যকালে বা কৈশোরে চিন্তাও করতে পারতেন না, সেসব খুব সহজলভ্য হয়ে গেছে তাঁদের হাতে-গড়া কিশোর বা তরুণ-প্রাণের কাছে। 

কিন্তু যে কারণেই হোক, তাঁরা এই পাল্টে যাওয়া দূষিত পৃথিবীটাকে ঠিক চিনে উঠেননি। এই প্রজন্মের সাথে এর বাবা-মায়ের গড়ে উঠেছে এক আজনবী সম্পর্ক। তাঁরা প্রায় ক্ষেত্রেই তাঁদের সন্তানদের বুঝাতে চান ঐভাবে, যেভাবে তাঁদের বাবা-মা তাঁদের বুঝাতেন। তাঁদের সন্তানদের সেভাবে চিনতে চান, যেভাবে তাঁদের বাবা-মায়েরা তাঁদেরকে চিনেছিলেন।
একই সাথে তাদেরকে 'একটু স্বাধীনতা' দিতে চান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের সময়টা বাঁচানোর জন্য। স্বাধীনতার সাথে যে নজরদারিতা প্রয়োজন, সেটাও তারা উপেক্ষা করে যান নিজেদের সময়-স্বল্পতার বাহানায়। 

কিন্তূ কেন যেন তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেন না তাঁদের শৈশবের পৃথিবী আর তাঁদের কলিজাগুলোর পৃথিবীর ভিন্নতা! বুঝেন না নিজ হাতে কোনদিকে ঠেলে দিচ্ছেন! তারপর বুঝতে পারেন না, বলা ভালো বুঝতে চান না তাদের সমস্যাগুলো, তাদের চাহিদাগুলো। তাঁরা বুঝেন না যে, তাঁদের হাতে-গড়া প্রাণগুলো এমন সমস্যায় পড়েছে যে সমস্যায় তারা নিজেরা পড়েননি। তাঁরা বুঝেন না, সন্তানের ভাষা। বুঝেন না, কোন ভাষায় সন্তানের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে! বলা বাহুল্য, তাঁরা চানই না সমাধান করতে! অনেকেই মনে করেন, 'এগুলো কিছু না!' , অনেকেই সন্তানকে লক্ষ্য করে বলে উঠেন - 'আমরা কি এমন সময় পার করিনি? আমরা কি কখনো তোর বয়সী ছিলাম না? তাই বলে আমরা কি তোর মতো করেছি?' 

অপরদিকে, ঠিক ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের ধারক হয়ে সন্তানদের অবাধ এই কলুষ দুনিয়ার কাছে উন্মুক্ত করে রেখেছেন। এমনকি নিজে সাজিয়ে-গুছিয়ে বিভিন্ন উসিলায় সন্তানকে অবাধ দুনিয়ার মুখোমুখি করে দেন। একটু স্বাধীন করে দিয়ে যে যার মতো করে তৃপ্তি প্রকাশ করেন, গর্ব করেন। তখন কেন যেন নিজেদের প্রশ্ন করেন না - 'আমরা কি এই ফেতনা গুলোর মুখোমুখি হয়েছি? আমাদের কচিমন কি কখনো এতো বিভ্রান্তি, এতো কষ্ট, পেরেশানিতে পড়েছিলো?' 

এই বাবা-মাদের হাত জোড় করে বলতে ইচ্ছে হয়, দয়া করে আপনার সন্তানের প্রতি একটু সমব্যথী হোন। ভাইরাসের কাছে উন্মুক্ত করে রেখেছেন, আক্রান্ত করছেন, ভাল কথা; দয়া করে প্রতিষেধকও তৈরি রাখুন, আপনার মায়া না হলেও আপনার সন্তানের যদি কখনো বোধদয় হয়, অন্তত নিরাময়ের চেষ্টা যেন করতে পারে। তখন অন্তত বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না।

আর দ্বীনের বাহক যারা, তারা কি ভাবেন? আপনার বাবা-মা দ্বীনের প্রতি যে ভালোবাসা তৈরি করে দিয়েছিলেন, অথবা আপনার রব আপনাকে দ্বীনের প্রতি নরম করে দিয়েছেন, ভালোবাসা দিয়েছেন; সেই ভালোবাসা আপনার সন্তানের অন্তরে রোপণ করলেন না, করতে চাইলেন না; বরং দ্বীনের প্রতি একরকম বিতৃষ্ণ করে রাখলেন, হারামের সাথে খাপ খাওয়ার অভ্যাস চরিত্রে রোপণ করে দিলেন! একটু কি চিন্তা হয়?..


এমন দিন কি কখনোই আসবে না, যেদিন বাবা-মা-পুত্র-কন্যা সম্পর্কগুলোর কোন মূল্য থাকবে না। যেদিন একজন আরেকজনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়ার সুযোগ খুঁজবে! যেদিন শুকরিয়ার অনুভূতি কাজ করবে না, কাজ করবে নিজেকে ভয়াবহ আগুন থেকে বাঁচাবার তাগিদ! 
বাবা-মায়ের হাত ধরে যাদের জীবন হয়েছিল ক্লেদাক্ত, দূষিত; তারা কি সেদিন বাবা-মাকে ক্ষমা করে দিয়ে শুকরিয়া জানাবে? 

আমার মনে পড়ে যায় নায়লা নুযহাত আপুর ঐ কথাটা - 'অকালে বড় হয়ে যাওয়া বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে আগে বলা দরকার নাকি কখনোই বড় হতে না পারা অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে, ভেবে পাই না!'

---

শেষ করি একজন ভালো মায়ের গল্প দিয়ে। তাঁর ছেলেটাও কথা শিখবার আগে শিখে গিয়েছিল ডিজিটাল জগতের ভাষা। ইচ্ছেমতো গেইমস ডাউনলোড করতে পারত, এমনকি শুনেছি পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখতো। তার কচি চোখগুলো স্বাভাবিকভাবে ঢাকা পড়েছে ভারি পাওয়ারের গ্লাসের আড়ালে। 
তার মা একদিন পিসির প্লাগ খুলে ফেললেন, ফোন বাজেয়াপ্ত করলেন। তারপর জীবনটা হয়তোবা বেশ পালটে গিয়েছিল। তার মায়ের ঐ কথাটা এখন কানে বাজে - 'আমার ছেলে আমার কাছে ফিরে এসেছে!' 

Friday, June 24, 2022

মাগরিবের সালাত শেষে ফেরার পথে ব্রীজটার উপর একটু থমকে দাঁড়িয়ে ছিল দীপ। সূর্য ডুবে গেছে বেশ আগেই, কিন্তু আকাশের বুকে স্মৃতি হিসেবে রেখে গেছে লালিমা। দিগন্তে পানির বুকে সে লালিমা অদ্ভূত এক অজানা অনুভূতির সৃষ্টি করে। যেন অপার কোন রহস্য লুকিয়ে আছে দিগন্তে।

সূর্যাস্তের সময় সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে অসীমে একাকার হতে চাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি দীপের কখনো। কিন্তু মনে হচ্ছে, সমুদ্র-সাক্ষাৎ না হবার যে আফসোস এতোদিন মনে পুষে এসেছে, তা আর আপাতত অনুভব না করলেও চলবে। দিগন্ত বিস্তৃত এই পানির নিচে আসলে ঢাকা পড়ে আছে দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত। কয়েকদিন আগেও ভাবুক দীপ এসে যখন এই ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে ঠিক এভাবে দিগন্তের দিকে তাকাত, সবুজ শ্যামলিমার সৌন্দর্যে সবকিছু ভুলে যেতে চাইতো। মাঝে মাঝেই রাত্রি নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করত সে, বহুদূর থেকে বয়ে আসা বাতাসে স্মৃতিকাতর হতে চাইতো, আর একটা আরেকটার গায়ে ঢলে পড়া চারাগুলো দেখে বিমোহিত হয়ে মনে মনে বলে উঠতো - আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবার। 

কে জানত, কয়েকদিন পরই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর মত করে এক সমুদ্র-সাক্ষাৎ হয়ে যাবে তার, আর আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ফেনা দেখে অবাক হয়ে সে বলে উঠবে - আল্লাহু আকবার। সত্যিই, কার ক্ষমতা আছে এত দ্রুত পটভূমি পালটে ফেলার? তবু মানুষ কার কাছে নত হয়?

সামান্য শোরগোল কানে আসতে পিছন ফিরল দীপ। কিছু দূরে তিনটা লোডেড ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। এগুলো আপাতত ওদেরই - আল-মুসাআদা ফাউন্ডেশন এর। তার সামনেই কয়েকজন দাঁড়িয়ে কী যেন বলাবলি করছে অস্থির হয়ে। ওদের কে চেনে দীপ - সবাই ই তাদের আল-মুসাআদা ফাউন্ডেশন এর। এর মধ্যে তিনজন হচ্ছে তাদের মুকাদ্দিমা টিমের। দ্বিতীয়বারের মত বন্যা এসে সব ভাসিয়ে নেবার পরপরই খুব দ্রুত তৈরি করা হয়েছিল এই মুকাদ্দিমা টিম। তাদেরকে তৈরি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে। উদ্দেশ্য - ফান্ড তুলে ত্রাণ তৈরি করতে করতে যেন টার্গেট লোকেশন সম্পর্কে ভালো একটা ধারণা হয়ে যায়, এতে দ্রুত ফলদায়কভাবে সাহায্য পৌঁছানো সম্ভব হবে।

দীপকে দেখে এগিয়ে আসলো মুকাদ্দিমা টিমের সাদাত। সাদাতের টিম গিয়েছিল উত্তর-পশ্চিমে, বোয়ালিয়া গ্রামের দিকে। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞাসা করল দীপ - কী খবর সাদাত? 

- অবস্থা ভয়ানক ভাইজান...

হড়বড় করে যা বলল সাদাত, তার সারাংশ হচ্ছে - বোয়ালিয়া গ্রাম শুধু ডুবেনি খুব ভালোভাবেই ডুবে গেছে, রাস্তার পানি পৌঁছে গেছে বুক পর্যন্ত। কিছু কিছু বাড়িঘর সামান্য উঁচুতে তৈরি হওয়াতে, সেগুলোতে পানি যদিও কিছুটা কম ঢুকেছে, কিন্তু বেশির ভাগ বাড়ির সবকিছু ডুবে গেছে। গ্রামে ছোটখাটো দুই-তিনটা টিলা থাকাতে কিছু কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে, তারপরও বেশ কিছু পরিবারের এক-দুজন করে সদস্য হারাতে হয়েছে। কারো পক্ষে তাও সম্ভব হয়নি, তারা চালার উপর উঠে আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু যে কোন মুহুর্তে ডুবে যাবার আশংকা। একে তো স্রোতের তীব্রতা, তার ওপর সাঁতার জানে এমন মানুষের সংখ্যাও বেশ কম। খুব দ্রুত এদেরকে উদ্ধার করা সম্ভব না হলে, অনেক প্রাণ একসাথে হারিয়ে যাবে।

একটু থেমে আরো দুয়েকটা সংবাদ দিলো সাদাত। টিলায় আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলোতে জরিপ করতে গিয়েছিল তারা। এক হিসেবে ভালো আছে তারা - অন্তত প্রাণ হারানোর ভয় নেই। কিন্তু তিনজন প্রেগন্যান্ট মহিলা আছেন, যাদের সময় প্রায় শেষের দিকে। এর মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর, এক-দুইদিনের ভিতর ব্যবস্থা না নিলে যে কোন মুহুর্তে মা-সন্তান দুজনকেই হারাতে হতে পারে। চালার উপর আশ্রিতদের মধ্যেও আছেন এমন একজন - আল্লাহর ইচ্ছেয় তার সময় যদিও ঘনিয়ে আসেনি; কিন্তু নিরাপত্তার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা করা দরকার।

সব শুনে দুই-এক সেকেন্ড চিন্তা করল দীপ। টুকটাক দুই-তিনটা প্রশ্ন করল। ফাউন্ডেশনের সহকারী জামিল ভাই দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশেই। তাকে বলল - ভাই আপনি কিছু ফার্স্ট এইড নিয়ে ট্রলারে এখুনি রওয়ানা দিয়ে দিন। আমি ত্রাণ নিয়ে একটু পরেই ইনশাআল্লাহ ফলো করছি।

জামিল ভাই মাথা নেড়ে জিজ্ঞাসা করলেন - আপনি কী করবেন ভাই? 

- আপনি যান ভাই। আমি আসছি একটু পরই।

বলতে বলতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো দীপ। 

মাগরিবের সালাত আদায় করে কিছু কাপড় গুছাতে গুছাতে অযীফা আদায় করে নিচ্ছিল শ্রেয়া। দরজার টোকার শব্দে একটু অবাক হলো। দীপের তো এখন আসার কথা নয়!

দরজা খুলে বিস্মিত স্মরে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করল - কী ব্যাপার! তুমি না বলেছিলে সালাত শেষে ত্রাণ নিয়ে দ্রুত চলে যাবে!

একটু হাসল দীপ - আরে ঢুকতে তো দিবে!

দরজা লাগিয়ে দ্রুত রান্নাঘরে চলে এল শ্রেয়া। দীপ এসেছে এবং তার চেহারায় তাড়াহুড়া নেই। তার মানে না হলেও অন্তত ১০-১৫ মিনিট বাসায় থাকবে, এর মধ্যে যদি ছোট করে কিছু হাজির করা যায়...

কড়াই বসিয়ে ফ্রিজ থেকে ফ্রোজেন সিঙ্গাড়া বের করে নিল শ্রেয়া। ভাগ্যিস, চায়ের লিকার করাই ছিল! চায়ের পাত্রটাও বসাতে বসাতে আড়চোখে দেখলো দীপ হাজির। 

 - হ্যাঁ এখন বলেন শুনি, কী করতে এসেছেন। এখানেই বা কী করছেন?

মুচকি হাসল দীপ। শেলফ থেকে দুটো কাপ নামিয়ে নিল - হেল্প নিতে এসেছি। 

কিছু বুঝলো না শ্রেয়া। এ কেমন আজগুবি কথা হলো! হেল্প করছে, আর বলছে হেল্প নিতে এসেছে...

দ্রুত হাতে দুজনে নাস্তা রেডি করে বসলো। দীপের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে শ্রেয়া চায়ে চুমুক দিলো। দীপ একটা সিঙাড়া হাতে নিয়ে বললো - 

- শুনো, একসময়ে একজন মানুষ ছিলেন। পৃথিবীর অর্ধেকটার উপর ছড়ি ঘুরাতেন। চলো আজকে তার সম্পর্কে একটু মুযাকারা করি। 

শুনে একটু হাসি পেল শ্রেয়ার। এ কথার মানে হচ্ছে শ্রেয়াকে এখন বসে বসে কোন জানা গল্প শুনতে হবে। গল্প শেষে দীপ তার কোন একটা সিদ্ধান্তের কথা তাকে জানাবে, তারপর কনক্লুডিং লাইন হিসেবে বলবে - 'এতটুকু কি আমরা করতে পারি না?' তার কনক্লুডিং লাইন শুনে শ্রেয়া বাধ্য মেয়ের মতো তার সিদ্ধান্তে সায় জানাবে। 

কিন্তু এই তাড়াহুড়ার সময়ে দীপের এই কাহিনী করার মানে কী, বুঝতে পারছে না শ্রেয়া। তাহলে কি দীপ ত্রাণ নিয়ে যাবে না? একটু মনখারাপ হলো শ্রেয়ার। অনেক আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে এলাকার মেয়েদের সাথে সেও ত্রাণের প্যাকেটগুলো গুছিয়ে দিয়েছিল। এ কথা ভেবে খুশি ছিল যে, কিছু তো করতে পারছে আর নিজে যেতে না পারলেও দীপ যাবে ভেবে মনটা ভালো হয়ে যাচ্ছিল তার। এখন কি তাহলে...

তার চিন্তার স্রোত টের পেল দীপ। হেসে বলল - শুনো আমরা যদি একটু মুযাকারা করি, আমাদের কাজে ইখলাস তৈরি হবে, উদ্দীপনা বাড়বে। তাছাড়া এতো কষ্ট করে চা টা বানিয়ে আনলাম, শেষ করতে একটু সময় লাগবে তো! 

সায় না দিয়ে পারল না শ্রেয়া - হ্যাঁ বলো।

- তো অর্ধরাজ্যের রাজা একদিন ঘুরছেন। ঘুরছেন মরুভূমিতে। ঘুরে ঘুরে দেখছেন, এমন কেউ আছে কিনা যে তৃষ্ণার্ত, বা ক্ষুধার্ত অথবা অন্য কোন ভীষণ বিপদে। অথবা, অল্প বিপদেও কেউ আছে কী না। কারণ তিনি রাজা হলেও তো তার মনে ভয়। তিনি তো জানেন যে, তাঁর দিকে কেউ কড়া নজর রাখছে। তিনি তাঁর দায়িত্ব সামান্য শিথিলতা দেখালেও ধরা পড়বার ভয়! তো তিনি চারদিক ঘুরে ফিরে দেখছেন।
তিনি যে রাজা, আমীরুল মুমিনীন, কেউ তো জানে না। সাধারণ বেদুইনের বেশে হাঁটছেন। হঠাৎ শুনতে পেলেন চিৎকারের আওয়াজ। আর্তনাদ ভেসে আসছে এক তাঁবু থেকে।

জানা গল্প হলেও আগ্রহ নিয়ে শুনছে শ্রেয়া। বলার ভঙ্গিতে জানা গল্পও এক এক সময়ে অসাধারণ লাগে।

সিঙ্গাড়ায় ছোট কামড় দিয়ে বলে গেল দীপ - তো অর্ধরাজ্যের রাজা তাড়াতাড়ি তাঁবুটার দিকে এগিয়ে গেলেন। বাইরে বসে থাকা বেদুইন লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ কী হয়েছে ভাই? কে এতো কষ্টের আওয়াজ করছে? 
লোকটা বিরক্ত হলো - নিজের কাছে যাও তো ভাই, আমাকে বিরক্ত করো না। এমনিতেই বহুত ঝামেলার মাঝে আছি।
কিন্তু অর্ধরাজ্যের রাজা তাকে ছাড়বেনই বা কেন! ধরে বসলেন - বলো না ভাই! হয়তো কোন সাহায্য করতে পারবো! 
অনেক গাঁইগুঁই করে তারপর বললো লোকটা, তিনি বাবা হতে যাচ্ছেন কিছু পরেই। ইমার্জেন্সি সাপোর্ট দরকার। কিন্তু এই রাতের বেলা এই মরুভূমিতে কোথায়ই বা পাবেন ইমার্জেন্সি হেল্প! স্ত্রীকে নিয়ে শহরে যাবার মতো অবস্থাও নেই, রেখে যাবার অবস্থাও নেই। কী করবেন ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না। 
শুনে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন অর্ধরাজ্যের রাজা। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন।  বাড়িতে গিয়ে স্ত্রীকে বললেন - বড় একটা ব্যবসায়ের সময় হয়েছে!  সাওয়াব অর্জনের সময় এসেছে...

আর লম্বা করতে দিলো না শ্রেয়া। হাসিমুখে বলে উঠল - তাই তুমিও তোমার স্ত্রীকে বলতে এসেছো যে সাওয়াব অর্জনের সময় হয়েছে! এতটুকু না করলে তা তো তোমার জন্য সত্যিই শোভা পেত না! 

চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলো দীপ। শ্রেয়া উঠে পড়ল। বিস্তারিত পরেও শোনা যাবে। এখন দ্রুত কিছু গুছিয়ে নিতে হবে। 

বিয়ের খুব বেশিদিন হয়নি তখন। তিন কি চার মাস। ভর দুপুরে ঘরে বসে খুব মন দিয়ে একটা বই পড়ছিল শ্রেয়া। হঠাৎ দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ। পাশের বাসার চাচীমার আওয়াজ শুনে দ্রুত খুলে দিল দরজা। প্রচন্ড গরমে ঘেমে নেয়ে আছেন চাচীমা। চোখে-মুখে পেরেশানির ছাপ স্পষ্ট। ঢুকেই বললেন - মা! নীনার পানি ভেঙে গেছে। তোমার কথা বলছে খুব! একটু আসবে? 

এ অবস্থায় না যাওয়ার কোন মানে হয় না। নীনা শ্রেয়ারই সমবয়সী। কিন্তু এর মধ্যে বিয়েতো হয়েছেই,  অলরেডি বাচ্চা ডেলিভারির টাইমও চলে আসছিল। এ জন্যেই মায়ের বাড়িতে আসা, আর প্রতিবেশী ভাবি হিসেবে শ্রেয়ার সাথে বন্ধুত্ব। দ্বীনের বুঝে একটু পার্থক্য থাকলেও তাদের বন্ধুত্বে সেটা বাধা হয়নি। তাই এই কঠিন সময়ে তাকেই তলব! এখন তো অবশ্যই যেতে হবে!

গিয়েছিল শ্রেয়া! বাচ্চাটা বের হওয়া পর্যন্ত পাশে ছিল। কিন্তু নিষ্পাপ দেহটা রুহ নিয়ে বেরোতে পারেনি। কীভাবে কী হয়েছিল বুঝতে পারেনি শ্রেয়া। শুধু বুঝেছে - দ্বীনদারিতার অভাবে একদিকে কী ভীষণ নির্লজ্জতা, আরেকদিকে অনভিজ্ঞ আয়ার হাতে নীনার কলিজার মৃত্যু। 
বাচ্চাটা যখন বের হতে শুরু করেছিল, রুহটা ছিল তখনো। কিন্তু দেহটা বের হতে হতে কীভাবে যেন প্রাণটাও চলে গিয়েছিল, এতটুকুই বুঝেছিল শ্রেয়া। 

তারপর ফুটফুটে মুখটা দেখেছিল সে, আর দেখেছিল মায়ের আর্তনাদ। সেদিন শ্রেয়া নিজেও কান্না আটকাতে পারেনি। এমনকি তার স্বাভাবিক হতেও দু-এক সপ্তাহ লেগে গিয়েছিল। তার বিষণ্ণতা দীপকেও স্পর্শ করত, কিন্তু তার কী-ই বা করার আছে। এমনি স্বান্তনা দিতো। 
তারপর একদিন দীপ ই তাকে প্রস্তাব দিলো - যদি চাও তো তোমাকে ব্যবস্থা করে দিই। একটা নার্সিং ট্রেনিং করে রাখো। হঠাৎ কাজে লেগে যাবে। 

প্রস্তাবটা শ্রেয়ার মনে ধরায় প্রেগনেন্সি রিলেটেড একটা ওয়ার্কশপে ওকে ভর্তি করিয়ে দেয় দীপ। কয়েকমাসে খুব আগ্রহ নিয়েই এটা শিখেছিল শ্রেয়া। ইকরামুল মুসলিমিনের নতুন সুযোগ তৈরি হবে ভেবে খুব ভালো লাগতো তার। তাছাড়া তার খুব মনে হত, দ্বীনের সাথে সম্পর্ক রাখে এরকম সব মেয়েরই এ ব্যাপারে প্রাথমিক ট্রেনিং নিয়ে রাখা উচিত। এ ব্যাপারে অনেককেই সে এখন উৎসাহিত করে। 

তারপর কয়েক জায়গায় গিয়েছিল শ্রেয়া ডেলিভারির সময়ে, কিন্তু বলা যায় অভিজ্ঞতা নিতে গিয়েছিল; শেখা কাজে লাগানোর সুযোগ আসেনি তেমন একটা...

---
অল্প কয়েকটা বাসন পড়ে ছিল সিংকে। শ্রেয়া রেডি হতে হতে সেগুলো ধুয়ে রেখে এসে দাঁড়াল দীপ। শ্রেয়াকে রেডি হতে দেখছে। জিজ্ঞাসা করল - কোথায় যেতে হবে জিজ্ঞাসা করলে না? 

দীপকে উসখুস করতে দেখে মজা পাচ্ছে শ্রেয়া - কেন, তুমি যেখানে খুশি নিয়ে যাবে, যাবো! এ ব্যাপারে সন্দেহ হচ্ছে নাকি? শুনি কোথায় নিয়ে যাবে, মঙ্গলগ্রহ? 

- না, অনেক দূরে যাবো। ট্রলারে করে যাবো। অনেক দূরে একটা দ্বীপে যাবো। 

- কী! 
অবাক হবে, খুশি হবে, না কী করবে ভেবে ভ্যাবাচেকা খেল শ্রেয়া।

হতভম্ব করে দিতে পারে এখন দীপের মজা লাগছে। কথা না বাড়িয়ে ছোট করে ডিটেইলস জানালো শ্রেয়াকে। আল্লাহকে পরম শুকরিয়া জানালো মনে মনে শ্রেয়া। এমন একটা সুযোগ পেয়ে, সর্বোপরি এমন ইকরামের জন্য প্রস্তুত জীবনসঙ্গীকে পেয়েছে বলে। 

ভীষণ লজ্জা লাগছে শ্রেয়ার। ভাগ্যিস অন্ধকার! না হলে মনে মনে 'ধরণী দ্বি-ধা হ' জপত। কিম্ভূতাকার লাগছে নিশ্চয়ই তাকে। কিন্তু কিছু করার ছিল না। এ সময়ে নিজেকে যত ইন্ডিপেন্ডেন্ট রাখা যায় ততই ভালো। টিপ টিপ বৃষ্টি তো হচ্ছেই। তাই বোরকার উপর একটা রেইন জ্যাকেট চাপিয়েছে। বড় হিজাবটা আজকে আর পরেনি, নড়াচড়ার সুবিধা হবে ভেবে ছোট হিজাবটাই চড়িয়ে এসেছে। বন্যার পানিতে পা ডুবাতে হবে নিশ্চয়ই যে কোন সময়ে, অথচ উপযুক্ত কিছুই ছিল না ঘরে। খালি পায়েও আসা যাবে না, আবার সাধারণ মোজা পরে আসলেও ভিজে কেলেঙ্কারি হবে! শেষমেষ একটা চামড়ার মোজা পেয়ে সেটাই পরে এসেছে, আবার বন্যার পানির কথা ভেবে হাঁটু পর্যন্ত পলিথিনও বেঁধে নিতে হয়েছে।
মনে মনে দীপকে বকছে শ্রেয়া। যদিও দীপেরও কিছু করার ছিল না, বাড়তি জিনিস জোগাড় করার সময় এমনিতেও নেই। তবু মনে মনে উধোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে যদি একটু শান্তি পাওয়া যায়! জোরে জোরে বললে তো নিশ্চয়ই বেজার হয়ে তাকে আর আনতোই না। যাব্বাবা, যা পেয়েছে তাই স্বান্তনা! 

চারপাশটা একটু দেখে নিলো শ্রেয়া। একটু দূরে লোডেড ট্রাকগুলো দাঁড়িয়ে আছে। এর পর থেকে আর ট্রাক যাওয়ার উপায় নেই। বাকি পথটা নৌকা বা ট্রলারে করেই টেনে নিতে হবে, কিছু করার নেই। এজন্য গাড়ি থেকে নেমে সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু একা লাগছে তার। দীপকে বলেও ছিল, একটু দেখবে নাকি তার সাথে আসার মত কাউকে পাওয়া যায় কিনা। দীপ মানা করল, তাছাড়া তাতে অনেক বেশি দেরি হয়ে যেত। তার পক্ষপাতি ছিল না দীপ। 
যাক, দীপকে না বলে লুকিয়ে ছোট একটা ছুরি নিয়ে নিয়েছে শ্রেয়া। একটু নিজেকে ভরসা দেওয়া আরকি! তেমন রিস্কের হলে তো দীপ নিজেই চিন্তা করতো না।  

বন্যার পানির গর্জনে অবাক লাগছে শ্রেয়ার। পানির স্রোত দেখে মনটা নরম হয়ে আসে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ! কত দ্রুত আল্লাহর শাস্তি এসে গ্রেপ্তার করে নিতে পারে! তবু একটু যদি বোধোদয় হত মানুষের! নিজে নিজে একটু তিলাওয়াত করতে ইচ্ছে করছে শ্রেয়ার... 

দীপ একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। শ্রেয়াকে দেখে দু'একজন একটু আপত্তি জানিয়েছিল। 'ভাই প্রাণ বড় না মান বড়?' এই কথা বলে তাদেরকে থামিয়ে দিয়েছে দীপ। এখন কথা হচ্ছে লোডিং নিয়ে। ফাউন্ডেশনের একটা ট্রলার আগে থেকেই ছিল, তারপর আর দু'টা ট্রলার ভাড়া করা হয়েছে। কয়েকটা নৌকাও নেয়া হয়েছে। কিন্তু এতদূর পর্যন্ত নৌকাগুলো কীভাবে নিবে তাই নিয়ে ভাবছে সবাই। 

অবশেষে ঠিক হলো, একটা ট্রলারে দীপ শ্রেয়াকে নিয়ে উঠে যাবে। সাথে ত্রাণ নিবে যতটা সম্ভব। আর দুটো ট্রলারের একটা তো জামিল ভাই আগেই নিয়ে গেছেন, অন্য ট্রলারে ফাউন্ডেশনের অন্যরা উঠে যাবে। দুটো ট্রলারের সাথেই দু/একটা করে নৌকা বেঁধে নেওয়া হবে, নৌকায় ত্রাণ থাকবে, মাঝিও থাকবে। ট্রলারের স্পিড খুব না উঠলেও মোটামুটি মধ্যম গতিতে পৌঁছে যাওয়া যাবে। আর বাকি নৌকাগুলো ধীরে ধীরে আসতে থাকুক। 

ততক্ষণে ইশার সময় হয়ে এসেছে। মোটামুটি একটা শুকনো জায়গা দেখে জামাত করে নামাজ পড়ে নিলো ওরা। তারপর লোডিং শেষ করে উঠে বসল সবাই। 

টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে এখনো। শ্রেয়ার অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, অনেক পথ পাড়ি দিয়ে খুব অজানা কোথাও যাচ্ছে। অন্তর সুকূনে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। একবার আকাশের দিকে তাকালো শ্রেয়া। পাশে বসা দীপকে একটু স্পর্শ করলো। এমন ভরসা থাকলে পৃথিবীর কোন জায়গাতে যেতেই শ্রেয়ার কোন দ্বিধা নেই! 

Wednesday, June 01, 2022

নিষ্পাপ-সঙ্গ

 একটা সময় ছিলো যখন নিষ্পাপ-সঙ্গ অর্থাৎ 'বাচ্চা-কাচ্চা' একরকম 'অপছন্দ' করতাম। কারণটা যথার্থ যুক্তিসঙ্গত ছিল(তখনকার হিসেবে) অর্থাৎ একনাগাড়ে কিছুক্ষণ পরপর কেঁউমেঁউটেঁউটেঁউ সহ্য করার মতো সহনশীলতা ছিল না। আর এগুলো ছিল নিখাদ 'কেঁউমেঁউটেঁউটেঁউ' ই। এর থেকে বেশি কিছু না। 

এখন হয়তো 'বয়স বেড়েছে'। মাঝেমধ্যে এক-আধটু উপভোগ করার চেষ্টা করি নিষ্পাপ-সঙ্গগুলো। শুধু উপভোগ না, কতকিছু আবিষ্কার করে ফেলি নিষ্পাপ-সঙ্গগুলোর আশ-পাশে থেকে থেকে। বরঞ্চ মনে হয় সঙ্গ হিসেবে অন্য অনেক কিছুর থেকে, অন্য অনেক সম্পর্ক থেকে, এই নিষ্পাপ-সঙ্গগুলো ভালো। যদি ভার হিসেবে না দেখে, 'জ্বালাতন' না ভেবে, একটু অন্যরকমভাবে দেখা সম্ভব হয়...একটু অন্যরকমভাবে চিন্তা করা সম্ভব হয়, তাদের এক একটা আচরণ, ভঙ্গি হয়তো এক একটা শিক্ষার ভান্ডার হয়ে দেখা দিবে।

যাক, বাচ্চাদের সবচেয়ে সুন্দর দুটো বিষয় হচ্ছে_আমার অনুভূতিতে_ভিজুয়ালাইজ করতে পারা এবং মনে রাখতে পারা। খাবার পর আহমাদকে হাত ধোয়াতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম - বলো তো, খাওয়ার সময় বিসমিল্লাহ না বললে কী হয়?
ভেবেছিলাম (যদিও ভাবা উচিত ছিল না) ভুলে গিয়েছে, কয়েক মাস আগে এগুলো মাথায় ঢুকানোর চেষ্টা করতাম, এখন নিশ্চয়ই মনে নেই...কিন্তু, চটজলদি উত্তর - শয়তান খেয়ে ফেলে! 
আমি অবাক, কিছুটা! তারপর ছোট ছোট নিষ্পাপ প্রশ্ন - 
-  আমি না খেলে কি শয়তান খাবে না?
-  না খাবে না, বিসমিল্লাহ বলে না খেলে তখন খেয়ে ফেলবে।
- বিসমিল্লাহ বলে খেলে কি শয়তান কানবে? [অর্থাৎ ভিজুয়ালাইজিং শুরু]
- হ্যাঁ, সবসময় বিসমিল্লাহ বলে খেতে থাকলে শয়তান কানবে। বলবে, আহমাদ খালি বিসমিল্লাহ বলে খায়, আমাকে খেতে দেয় না।

ঘুমাতে পাঠালাম। বললাম - যাও। বিসমিল্লাহ বলে ঘুমাবা। জোরে জোরে বলবা। তাহলে শয়তান তোমার সাথে ঘুমাতে পারবে না। 
অতএব জোরে জোরে 'আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া'। এবং রিপোর্ট - জোরে জোরে বিসমিল্লাহ বলছি।
- না হবে না, ঘুমানোর জন্য শুয়ে তারপর পড়তে হবে। (ঘুমানোর জন্য কিঞ্চিত বাইল) 

দুধ খেয়ে শুতে গেলো। জোরে জোরে দুয়া পড়বার আওয়াজ আবারও ভেসে এল কানে। 

ঘটালে এমন ঘটনা ঘটে। আমরা ঘটাই না বেখেয়ালিপনায়। বাচ্চারা নিষ্পাপ থাকে বলেই কী না, সত্যটা বললে ওরা দ্রুত ধরে নেয়। নেয় না কি? 
কিছুটা আক্ষেপ মিশ্রিত ভাবনা এসে ভিড় করে - কোন বড় মানুষকে বললে তো এই সত্যটা এতো সহজে গ্রহণ করতে পারতো না! নিজেই তো পারি না, যেকোন নতুন সত্যের সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে, দ্রুত গ্রহণ করে নিতে! 

এর পিছনে একটা বড় কারণ আমার মনে হয় - ভিজুয়ালাইজ করতে না পারা। আমাদের দৃশ্যমান পৃথিবীর বাইরে যে আরেকটা পৃথিবী আছে, তা অনুভব করতে না পারা। 

যতো বড় হতে থাকে, মানুষ তত বেশি সম্ভবত ভিজুয়ালাইজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে অর্থাৎ তাকে যা বলা হয় তা সে মনের চোখে দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যত নিষ্পাপ থাকে, যত ছোট থাকে, দুনিয়াকে যতটা কম চেনে, ততোটা বেশি হয়তো সে ভিজুয়ালাইজ করার ক্ষমতা রাখে। 

হয়তোবা, মনের চোখে দেখতে পারার ক্ষমতা কতটুকু এটা হিসেব করে নিজেকে বিচার করা সম্ভব যে, নিজেকে দুনিয়াতে দুনিয়ার বাহ্যিক রূপে কতটা হারিয়ে ফেলেছি। আর এই নিষ্পাপ-সঙ্গগুলো দিয়ে হয়তো কিছুটা হলেও নিজের আসলটাকে অনুভব করা, খুঁজে পাওয়া সম্ভব!